ভিডিও লিংকের মাধ্যমে আদালতে সু চি
মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গতকাল রোববার ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যেই আজ সোমবার বিচারের জন্য আদালতে হাজির করা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চিকে। তবে সশরীরে নয়, তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়েছে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, রাজধানী নেপিডোর একটি আদালতে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে সু চিকে হাজির করতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী খিন মং জঁ। তিনি জানান, ৭৫ বছর বয়সী এ নেত্রীকে এ সময় মোটামুটি সুস্থ বলেই মনে হয়েছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর সু চিকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁকে আটক করে নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি সু চির বিরুদ্ধে মামলা করে জান্তা সরকার। অভিযোগ করা হয়, তিনি আমদানি-রপ্তানি আইন ভঙ্গ করেছেন। তাঁর বাড়ি থেকে ওয়াকিটকি পাওয়া গেছে, যা তিনি বেআইনিভাবে আমদানি করে ব্যবহার করছিলেন। এ ছাড়া মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উই মিন্তের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়। সামরিক অভ্যুত্থানের সময় তাঁকেও আটক করা হয়েছিল। উই মিন্তের বিরুদ্ধে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিকে, মিয়ানমারে গতকাল জান্তাবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রাণহানির পর আজ সোমবার আবার দেশজুড়ে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেন আন্দোলনকারীরা।
গতকাল মিয়ানমারের বিভিন্ন শহর-নগরে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে গুলি চালায় পুলিশ।
এদিন তাদের সঙ্গে সড়কে নেমেছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। এ সময় গুলিতে অন্তত ১৮ জনের প্রাণহানির খবর জানা যায়। আহত হন অনেকে। গ্রেপ্তার করা হয় স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষকসহ অনেককে।
বিক্ষোভকারীদের ওপর এই দমন-পীড়নের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ। বিক্ষোভ দমনে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদিন যে পদক্ষেপ নেয়, তাকে ‘ঘৃণ্য সহিংসতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সরকারের পতন ঘটায় সেনাবাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় সু চিসহ এনএলডির শীর্ষ নেতাদের। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনী এই অভ্যুত্থান ঘটায়। এরপর থেকেই দেশটিতে বিক্ষোভ চলে আসছিল। গত শনিবার পর্যন্ত এসব বিক্ষোভে সব মিলিয়ে তিনজন নিহত হন। আর গতকাল এক দিনে ঝরল অন্তত ১৮ জনের প্রাণ।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশ ও সেনারা গুলি চালিয়েছেন। এসব ঘটনায় অন্তত ১৮ জন নিহত এবং ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
গতকাল সকাল থেকেই পুলিশ ছিল মারমুখী। মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুনে বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রথমে স্টান গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয়। এতেও বিক্ষোভকারীদের দমানো না গেলে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এই শহরে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন শিক্ষকও রয়েছেন। সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালালে তিনি নিহত হন। এ ছাড়া ইয়াঙ্গুনের একটি মেডিকেল স্কুলের সামনের বিক্ষোভেও পুলিশ স্টান গ্রেনেড ছুড়েছে।
হোয়াইটকোট অ্যালায়েন্স অব মেডিকস নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, চিকিৎসক, নার্সসহ কমপক্ষে ৫০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিবিসি জানায়, ইয়াঙ্গুনে গতকাল কমপক্ষে চারজন নিহত হয়েছেন।
ইয়াঙ্গুনে একটি হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বেশ কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বুকে গুলি লেগেছিল।
শুধু ইয়াঙ্গুন নয়, গতকাল মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরেই গুলি চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দাওয়েইর রাজনীতিক কিয়াও মিন হতিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, এই শহরে তিনজন নিহত হয়েছেন। তবে বিবিসি জানায়, এই শহরে এদিন চারজন নিহত হয়েছেন।
মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার নাউ জানিয়েছে, দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে বিক্ষোভে দুজন নিহত হয়েছেন। তবে স্থানীয় বাসিন্দা সাই তুন রয়টার্সের কাছে দাবি করেছেন, এই শহরে পুলিশ দফায় দফায় গুলি চালিয়েছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিনজন।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, মিয়েইকো, বাগো ও পোকোক্কু এলাকায়ও বিক্ষোভে গুলি চালানোর এবং প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এমআরটিভি জানিয়েছে, গত শনিবার দেশজুড়ে অভিযান চালিয়ে ৪৭০ জনের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে গতকাল কতজন গ্রেপ্তার বা আটক হয়েছেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
মিয়ানমারের তরুণ বিক্ষোভকারী এসথার জে নাও রয়টার্সকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী আঘাত করে আসলে আমাদের মনে ভয় গেঁথে দিতে চাইছে। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না।’ নিয়ান উইন শেইন নামের আরেক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘তারা যদি আমাদের পেছনে ঠেলতে চায়, আমরা আরও জেগে উঠব। তারা যদি আমাদের আক্রমণ করে, আমরা আত্মরক্ষা করব। সামরিক বুটের সামনে আমরা কখনো মাথানত করব না।’
অ্যামি কিয়াও নামের এক বিক্ষোভকারী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমরা বিক্ষোভ শুরু করতেই পুলিশ গুলি চালায়। তারা কোনো সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেনি।’
মিয়ানমারে সহিংসতার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, বিভিন্ন শহর-নগরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি চালানোর ঘটনা ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য।
মিয়ানমারে কানাডার দূতাবাস বলেছে, সহিংসতা এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন বেড়ে যাওয়ায় কানাডার সরকার বাকরুদ্ধ। আর ইন্দোনেশিয়া বলেছে, তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘মিয়ানমারে বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা সেনাবাহিনীকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অবিলম্বে বলপ্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যাঁরা বিক্ষোভ করছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাঁদের সঙ্গে সংহতি জানাচ্ছে।