বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আরও ২৯ বছর যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন তিনি
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ৬ ও ৯ আগস্ট ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা ফেলল। এরপর আত্মসমর্পণ করল জাপান।
কিন্তু একজন জাপানি সৈনিক যুদ্ধ শেষ বলে মানলেন না, বিশ্বাস করলেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অস্ত্র জমা দেওয়া সৈনিক তিনি। তাঁর নাম হিরু ওনোদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ২৯ বছর পর পর্যন্ত হিরু ওনোদা জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন।
ওনোদা ছিলেন সামুরাই বংশের সন্তান। বাবাও সৈনিক ছিলেন। ১৯২২ সালে জন্ম নেওয়া ওনোদা নিলেন ‘ফুতামাদা’ কমান্ডো প্রশিক্ষণ। এ হচ্ছে অপ্রচলিত যুদ্ধ শিক্ষা, কমান্ডো—যারা গেরিলা যুদ্ধ করে, শত্রুর আক্রমণ লন্ডভন্ড করে, প্রতিকূল পরিবেশে কারও সাহায্য ছাড়া টিকে থাকতে পারে।
ছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তাঁর দায়িত্ব ছিল শত্রুপক্ষের অভিযান বানচাল করা। ধরা পড়লে জাপানি সৈনিকেরা অবলীলায় নিজেদের প্রাণ নিজেরাই নিতেন। এটা জাপানি সামুরাই যোদ্ধাদের প্রচলিত নিয়ম। অন্য কারও অস্ত্রে প্রাণ দেওয়ার মতো অপমান থেকে বাঁচার জন্য এই প্রথা। কিন্তু গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে ওনোদার আত্মহত্যার বা আত্মসমর্পণের নির্দেশ ছিল না। হিরু ওনোদা ২২ বছর বয়সে ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে নিযুক্ত হন।
এর দুই বছর আগে জাপানি রাজকীয় বাহিনী ফিলিপাইন দখল করে নিয়েছে। সেখানে তখন মার্কিন বাহিনীও আছে। জাপানি বাহিনী সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। ফলে মার্কিন বাহিনী যখন পাল্টা আক্রমণ শুরু করল, জাপানি বাহিনী বিশেষ সুবিধা করতে পারল না।
১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে জাপানি বাহিনী পিছু হটে বড় দ্বীপ ছেড়ে ছোট দ্বীপগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিল। লুবাং ছিল তেমনই এক ছোট দ্বীপ। এমন পরিস্থিতিতে ওনোদাকে পাঠানো হলো সেই দ্বীপে। তাঁর গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ এখানে কাজে লাগবে বলে ভেবেছিলেন তাঁর ওপরওয়ালা অফিসাররা।
হেরে যাওয়ার আগে মার্কিন আর ফিলিপিনো বাহিনীকে যথাসম্ভব ঠেকিয়ে রাখার জন্য চোরাগোপ্তা হামলা চালাত জাপানিরা। লক্ষ্য ছিল, পাল্টা আক্রমণের জন্য জাপানি বাহিনীকে গুছিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যথাসম্ভব বেশি সময় দেওয়া। ফিলিপাইন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এটা হাতছাড়া হওয়া মানে জাপানের মূল ভূখণ্ডের কাছে মার্কিনদের পৌঁছে যাওয়া।
হিরু ওনোদা যখন লুবাং দ্বীপে পৌঁছালেন, তাঁর ওপরের কর্মকর্তা গেরিলা যুদ্ধে না গিয়ে সরাসরি মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ছোট দ্বীপটিতে মার্কিন সৈন্য অবতরণ করল। জাপানি বাহিনীর দ্রুত পরাজয় ঘটল। ওনোদা তাঁর দুই সহযোদ্ধা নিয়ে জঙ্গলে চলে গেলেন। উদ্দেশ্য ছিল, গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। সেই যুদ্ধ তিনি চালিয়ে গেলেন পরবর্তী ২৯ বছর।
এতগুলো বছর তাঁরা খেয়েছেন গ্রাম থেকে চুরি করা চাল, নারকেল, গ্রামের কৃষকদের গবাদিপশু, আর কখনো বন্য শূকর।
আগস্ট ১৯৪৫–এ জাপান-মার্কিন লড়াই শেষ হলো। ওনোদা লক্ষ করলেন, কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু তাঁর দেশ যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়েছে—এ কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবলেন না। তিনি তাঁর যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায়, তাঁর খোঁজে আসা পুলিশের সঙ্গে লড়াই চলতে লাগল।
নিজ বাহিনীর সঙ্গে ওনোদা আগেই যোগাযোগ হারিয়েছিলেন। মার্কিনরা কয়েকবার চেষ্টা করল খবর পৌঁছানোর যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এমনকি উড়োজাহাজ থেকে লিফলেটও ফেলা হলো। ওনোদার হাতেও সেই লিফলেট পড়ল। তিনি একে ধোঁকা দেওয়ার প্রচারণা বলে উড়িয়ে দিলেন। তাঁকে ট্রেনিংয়ে যে এসব শেখানো হয়েছিল।
১৯৪৫ সালের শেষের দিকে আরও লিফলেট ছড়ানো হলো। সেখানে নিযুক্ত জাপানি বাহিনীর জেনারেল তোমোয়ুকি ইয়ামাশিতার আত্মসমর্পণ করার আদেশও ছাপানো ছিল। একেও ওনোদার দল ধাপ্পা বলে ভেবে নিলেন। সামুরাই বংশের ছেলে ওনোদা কল্পনাও করতে পারেননি যে তাঁর দেশ জাপান আত্মসমর্পণ করতে পারে। তাঁকে তো শেষ যোদ্ধা বেঁচে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে শেখানো হয়েছে! সুতরাং ওনোদার তিনজনের বাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে গেল।
১৯৪৯ সালে একজন যোদ্ধা ইয়ুচু আকাতসু ধারণা করলেন, যুদ্ধ বোধ হয় শেষ হয়েছে। তিনি দল থেকে আলাদা হয়ে ফিলিপিনো বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। এবার পুরো পৃথিবী ওনোদার যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারল। ওনোদার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের হাতে লেখা চিঠিও লিফলেট করে উড়োজাহাজ থেকে ছড়ানো হলো ১৯৫২ সালে। ওনোদা এটাও প্রচারণা বলে উড়িয়ে দিলেন। ভাবলেন, তাঁর পরিবারের লোকদের বন্দী করে জোর করে এসব লেখানো হয়েছে।
এরপরের দুই যুগ ওনোদা কঠিন যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর সহযোদ্ধা শোইচি শিমাদা ফিলিপিনো বাহিনীর হাতে নিহত হলেন। ১৯৭২ সালে গ্রামের এক চালের দোকান জ্বালানোর সময় শেষ সহযোদ্ধা কিনশিচি কোজুকা পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন।
ওনোদা এবার একা। পুরো পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ তখনো থামল না। তত দিনে নতুন জাপানের মানুষেরা এই পুরোনো দিনের মূল্যবোধের মানুষটির কথা জেনে গেছে। তাঁর গল্প জাপানের ঘরে ঘরে। এমনই একজন নোরিও সুজুকি। তিনি এমনিতে পরিব্রাজক ছিলেন, ঘোষণা করলেন যে তিনি ওনোদার সঙ্গে দেখা করবেন।
সুজুকি সফল হলেন। ওনোদার সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। বৃদ্ধ যোদ্ধাকে বললেন, ‘সম্রাট আর জাপানের মানুষ আপনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে।’ সম্রাট ছাড়া আর কারও কথায় ওনোদা টলবার মানুষ ছিলেন না। ওনোদা বললেন, ‘আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ ছাড়া তো আমি যুদ্ধ থামাতে পারি না।’ জাপান সরকার সেই খবর পেয়ে যুদ্ধের সময় ওনোদার কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োশোমি তানিগুচিকে খুঁজে বের করল। তিনি তত দিনে বাহিনী ছেড়ে বইয়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন। তাঁকে ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হলো।
এই বার, প্রায় ত্রিশ বছর পর, ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ, ৫২ বছর বয়সী হিরু ওনোদা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন। তখনো তাঁর পরনে উনত্রিশ বছর আগের ছেঁড়া ইউনিফর্ম, হাতে সার্ভিস রাইফেল, কোমরে তলোয়ার। তিনি এসে তাঁর কমান্ডিং অফিসার মেজর ইয়োশোমি তানিগুচির সামনে সটান দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বললেন, ‘পরবর্তী আদেশ, মেজর?’
কমান্ডিং অফিসারের আদেশে হিরু ওনোদা অস্ত্র সমর্পণ করলেন। রাইফেল, ৫০০টি গুলি, তলোয়ার, ছুরি। তারপর নিয়মমতো দেশের পতাকার উদ্দেশে স্যালুট করলেন। শেষ হলো উনত্রিশ বছরের যুদ্ধ। তিনি যুদ্ধাপরাধ থেকে অব্যাহতি পেলেন আত্মসমর্পণের শর্তে।
দেশে তিনি বীরের সম্মান পেলেন। কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী জাপান মেনে নিতে পারেননি ওনোদা। যুক্ত হয়েছিলেন শক্তিশালী যুদ্ধপ্রিয় জাপানি জাতি গঠনের জন্য ডানপন্থী রাজনীতিতে। তিনি মারা যান ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি। মৃত্যুর আগে জাপানি শিশুদের প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সংগঠন খুলেছিলেন। বলতেন, এভাবে অন্তত পুরোনো জাপানের কিছু মূল্যবোধ নতুন দিনের শিশুদের শেখানো যেতে পারে। হয়তো দীর্ঘদিন অরণ্যবাসের কারণে এই ইতিবাচক ফল তিনি পেয়েছিলেন।