দেশ ছাড়ার ‘অপরাধবোধ’ কুরে কুরে খায় তাঁদের
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে জান্তা সরকারের ক্ষমতা দখলের এক বছর পূর্তি হলো ১ ফেব্রুয়ারি। সেই সময়টায় দেশটির সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুন ছিল গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ–মিছিলে উত্তাল। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রথম দিকে জান্তা সরকার সংযত আচরণ করলেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা সহিংস হয়ে ওঠে। নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে নির্বিচার লাঠিপেটা, গ্রেপ্তার, স্নাইপার কুকুর ব্যবহার, এমনকি খুব কাছ থেকে গুলি করা শুরু করে।
বিক্ষোভের তথ্যচিত্র তৈরি করতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিয়ানমারজুড়ে ছুটে বেড়িয়েছেন খিত থিত। ইয়াঙ্গুনের কাছেই সানচাউং-এর এক ঘিঞ্জি গলিতে বিক্ষোভের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অল্পের জন্য পুলিশের হাতে ধরা পড়া থেকে বেঁচে যান তিনি। ওই ঘটনার পর কাছের একটি হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন খিত। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বের হয়ে হোটেল লাগোয়া একটি ভবনের ছাদে চলে যান। দেখতে পান, পুলিশ এক বিক্ষোভকারীকে নির্মমভাবে পেটাচ্ছে। আর ওই বিক্ষোভকারী তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন।
খিত বলেন, সেই সময় দিনের চেয়ে রাতটা তুলনামূলক ভালো ছিল। কারণ, অন্ধকার কেটে গেলেই সেনারা পাড়ায় পাড়ায় টহল দিত। কাউকে সন্দেহ হলে বাড়ি ঢুকে ধরে নিয়ে আসত। তিনি আরও বলেন, ‘তখন সত্যিই খুব আতঙ্কের সময় ছিল। ওই সময়ে আমি ঘুমাতে পারতাম না। সারাক্ষণ মনে হতো, যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারি।’
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর থেকে দেড় হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তবে দেশজুড়ে অগুনতি সশস্ত্র হামলায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের সঠিক হিসাব নেই। অপরদিকে জাতিসংঘের হিসাবে গত এক বছরে মিয়ানমারে তিন লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
অভ্যুত্থানের পর আরও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন খিত থিত। একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সীমান্ত এলাকায় পালিয়ে গিয়ে বিকল্প সরকার নামে পরিচিত এনইউজির সামরিক শাখা—পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)-এ যোগ দেন। কিন্তু ইয়াঙ্গুনেই থেকে যান খিত। আশা ছিল, ধীরে ধীরে শহরের অবস্থা ভালো হবে, আর তখন লেখনীর মাধ্যমে তা বিশ্ববাসীকে জানাবেন তিনি। কিন্তু দিনে দিনে সাবেক এ রাজধানীর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। একপর্যায়ে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রত্যন্ত এলাকায় নিজের গ্রামে চলে যান।
খিতের প্রতিবেশীরা তাঁর সাংবাদিক পরিচয় জানত। তাঁদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁর বিষয়টি বলে দিতে পারে বলে উদ্বিগ্ন ছিলেন। হঠাৎ করে জান্তা সরকারের কেউ যদি তাঁর খোঁজে আসে তখন কী হবে? এটা নিয়ে মায়ের সঙ্গে বসে পরিকল্পনাও করেন। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেন, এমন পরিস্থিতিতে পড়লে পেছনের জানালা দিয়ে পালিয়ে মঠে লুকিয়ে থাকবেন।
এ নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কেটে যায় কয়েক সপ্তাহ। একপর্যায়ে দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খিত। বলেন, ‘আমি বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। এটি খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। আমি কোনো দিন অন্য দেশে পাড়ি দিয়ে পরিবারকে ছেড়ে আসার কথা ভাবিনি। সবচেয়ে বড় কথা, আমি একধরনের অপরাধবোধে ভুগছি। কারণ, আমার বন্ধুরা জঙ্গলে থেকে দেশের জন্য লড়ছে, আর আমি শুধু নিজের কথা ভেবেছি।’
খিত আরও বলেন, ‘উড়োজাহাজে ওঠার পর একধরনের স্বস্তি কাজ করলেও মনটা ছিল বিষণ্ন। কারণ আমি জানি না, কবে ফিরতে পারব।’ নিজের মধ্যে অপরাধবোধ এতটাই কাজ করছিল যে লজ্জায় দেশ ছাড়ার কথাটুকু তিনি বন্ধুদের জানাতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে কেটে গেছে ৯ মাস।
খিতের মতোই অভিজ্ঞতা মিয়ানমারের আরেক নাগরিক জন মং লুইনের। সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশ ছাড়ার আগপর্যন্ত কয়েক মাস তিনি লুকিয়ে ছিলেন। সারাক্ষণ মনে হয়েছে এই বুঝি গ্রেপ্তার হলেন। মং বলেন, ‘আমি অপরাধবোধে ভুগি। কারণ, মনে হচ্ছে আমি স্বার্থপর। দেশ ছাড়ার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। এ সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু নিরাপদে দেশে ছাড়তে পারলেও স্বস্তি পাচ্ছি না কিছুতে।’
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে অনেকের জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। অর্থনৈতিক খাতে ধস নেমেছে। গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ শতাংশ।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার মিশেল ব্যাশেলেটের মতে, এ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে জান্তা ‘মানুষের জীবনের প্রতি চরম নির্মমতা’ দেখিয়েছে। এর মধ্যে আছে সাংবাদিক নির্যাতন, গ্রামবাসীকে নিশানা করে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন চালানো, ঘনবসতি এলাকায় বিমান হামলা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হামলা।
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর থেকে দেড় হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তবে দেশজুড়ে অগুনতি সশস্ত্র হামলায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের সঠিক হিসাব নেই। অপরদিকে জাতিসংঘের হিসাবে গত এক বছরে মিয়ানমারে তিন লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
অপরদিকে, পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে খিত এবং মং–এর মতো অনেকে প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড বা ভারতে গেছেন। অন্যরা সুবিধামতো অন্যান্য দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। নিরাপত্তাহীনতার ভয় এবং আয়রোজগারের নিশ্চয়তার অভাবে দেশে ফিরতে তেমন আগ্রহী নন তাঁরা।
দেশত্যাগী আরেকজন নিকি ডায়মন্ড। অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারে একজন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর প্রথমে ইয়াঙ্গুন ছাড়েন তিনি। পরে মিয়ানমারই ছেড়ে যান। জান্তা সরকারের ধরপাকড়ের তালিকায় নিকির নাম ছিল। জান্তার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তিনি এখন সপরিবার জার্মানিতে আছেন। পিএইচডির গবেষণা করছেন।
নিকিরও ভাষ্য, মিয়ানমার ছাড়ার সময় ভীষণ মন খারাপ ছিল তাঁর। কিন্তু ‘বেঁচে থাকার অপরাধবোধে’ ভুগছেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা তো দেশ ছেড়ে আসতে পেরেছি; কিন্তু অন্যরা এখনো সেখানেই রয়ে গেছেন।’ তাঁর মতে, যাঁরাই দেশ ছেড়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের দায়িত্ব দেশে যা হচ্ছে তা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। সবাই সশস্ত্র অধিকারকর্মী হবেন না। অনেকে আছেন, যাঁরা শহরে থেকে অহিংস বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে তাঁদের থাকার স্থান পরিবর্তনের জন্য অর্থসহায়তা প্রয়োজন। তাঁদের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
এটি খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। আমি কোনো দিন অন্য দেশে পাড়ি দিয়ে পরিবারকে ছেড়ে আসার কথা ভাবিনি। সবচেয়ে বড় কথা, আমি একধরনের অপরাধবোধে ভুগছি।
তবে দেশ ছাড়ার পরও সাম্প্রতিক সময়ে নিক নিজের অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। তিনি মনে করেন, দেশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করতে পারেন। সম্প্রতি দেশ ছাড়ার বিষয়টি বন্ধুদের জানিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘আমি নিরাপদে আছি জানতে পেরে তারা খুশি হয়েছে। আমি এতটা আশা করিনি।’
নিকের মতো খিতও আশাবাদী। বলেন, ‘বিদেশে বসে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি যা করতে পারি তা হলো, পুরো বিশ্বের কাছে মিয়ানমারের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা। শেষ পর্যন্ত যা–ই করি না কেন, আমার দেশের জন্য সর্বোচ্চটুকু করব। আশা করি, আমার এ কাজ ক্ষমতা থেকে জান্তাকে সরাতে এতটুকু হলেও সহায়তা করবে।’
আল–জাজিরার ইংরেজি প্রতিবেদন থেকে অনুবাদ করেছেন লিপি রানী সাহা