শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ফিরে আসায় দেশটিতে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়ার ভবিষ্যৎ কী, তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কার মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে।
ঊর্ধ্বতন একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স বলেছে, গোতাবায়া রাজাপক্ষে আজ শনিবার ভোরে কলম্বোয় ফিরেছেন।
রাজাপক্ষে প্রবল প্রতাপে শ্রীলঙ্কা শাসন করেছেন। একসময় তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে কয়েক দশক ধরে চলা আর্থিক সংকটের জেরে ও রাজনীতিতে রাজাপক্ষে পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতিবাদে গোতাবায়ার পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা তাঁর রাজপ্রাসাদে ভাঙচুর চালান।
সিঙ্গাপুরে গোতাবায়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ থেকে এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতায় না থাকায় গোতাবায়ার ক্ষেত্রেও আইন অন্যদের মতোই প্রযোজ্য হবেআইটিজেপির নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন সুকা সুকা
এর এক দিন পরে গত ১৩ জুলাই তিনি পালিয়ে মালদ্বীপে চলে যান। মালদ্বীপ থেকে সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডে যান গোতাবায়া। শ্রীলঙ্কার চরম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় কেন তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন, কেনই–বা ফিরে এলেন, সে বিষয়ে গোতাবায়া রাজাপক্ষে মুখ খোলেননি।
অধিকারকর্মীদের একাংশ বলছে, রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হতে পারে। তবে রাজাপক্ষের মিত্ররা এখন ক্ষমতায় রয়েছেন। তাই বিশ্লেষকেরা বলছেন, তাঁর বিচারের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
শ্রীলঙ্কায় একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন গোতাবায়া। কয়েক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন রাজাপক্ষে। তবে এই জনপ্রিয়তা শেষ পর্যন্ত টেকেনি।
শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার কমিশনের সাবেক কমিশনার ও আইনজীবী আম্বিকা সাথকুনানাথান বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত এক নেতা হিসেবে স্থায়ী বা অস্থায়ী আবাস পাওয়া রাজাপক্ষের জন্য কঠিন হবে। এটা তাঁর কল্পনার চেয়েও বেশি কঠিন হবে। আম্বিকা আরও বলেন, তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন, যাঁকে দেবতা বলে মনে করত দেশের মানুষ। তবে তিনি কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে অভ্যস্ত নন।
সিঙ্গাপুরে থাকাকালে রাজাপক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীলঙ্কার নেতা হিসেবে পদত্যাগ করেন। ২৩ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রোজেক্টের (আইটিজেপি) আইনজীবীরা সিঙ্গাপুরের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে
বিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে রাজাপক্ষে প্রথম যান মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে। ঊর্ধ্বতন একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলছেন, মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ নাশিদ হস্তক্ষেপ না করলে রাজাপক্ষেকে বহনকারী উড়োজাহাজটি অবতরণের অনুমতি পেত না। তবে মালেতে থাকা শ্রীলঙ্কানরা রাজাপক্ষে সেখানে যাওয়ায় খুশি হতে পারেননি। রাজাপক্ষে যাওয়ার প্রতিবাদে মালের বিভিন্ন রাস্তায় বিক্ষোভ হয়।
একজন বিক্ষোভকারী হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘তাঁকে এখান থেকে ছুড়ে ফেলে দিন’। আরেক বিক্ষোভকারীর হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘মালদ্বীপের প্রিয় বন্ধুরা, তোমাদের সরকারকে অপরাধীকে আশ্রয় না দিতে বলো’।
৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে রাজাপক্ষে সৌদিয়া ফ্লাইটে মালদ্বীপ ছেড়ে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা হন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৪ জুলাই নিশ্চিত করেছে যে রাজাপক্ষেকে সেখানে ব্যক্তিগত সফরের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রাজাপক্ষে সেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করেননি অথবা তাঁকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়নি বলেও জানানো হয়। সে সময় বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার খবরে জানানো হয়, রাজাপক্ষে সৌদি আরব সফর করবেন। তবে তিনি সৌদি আরবে যাননি।
সিঙ্গাপুরে থাকাকালে রাজাপক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীলঙ্কার নেতা হিসেবে পদত্যাগ করেন। ২৩ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রোজেক্টের (আইটিজেপি) আইনজীবীরা সিঙ্গাপুরের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
আইনজীবীরা রাজাপক্ষেকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে অনুরোধ জানান। শ্রীলঙ্কায় ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ চলাকালে প্রতিরক্ষাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।
তবে রাজাপক্ষে অভিযোগ অস্বীকার করেন। ২০১১ সালে জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলা, তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড, ধর্ষণ, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ স্থগিত করার মতো অপরাধের জন্য শ্রীলঙ্কার সরকারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন আরও বলছে, বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এ ধরনের ঘটনায় ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক মারা গেছেন।
সিঙ্গাপুরের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের মুখপাত্র সিএনএনকে আইটিজেপির অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আইটিজেপির নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন সুকা সুকা বলেছেন, সিঙ্গাপুরে গোতাবায়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ থেকে এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতায় না থাকায় গোতাবায়ার ক্ষেত্রেও আইন অন্যদের মতোই প্রযোজ্য হবে।
থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলছেন, কূটনৈতিক পাসপোর্ট থাকায় গোতাবায়া রাজাপক্ষে ভিসা ছাড়াই দেশটিতে ঢুকতে পেরেছেন। ৯০ দিন পর্যন্ত তাঁর সেখানে থাকার অনুমতি ছিল। ওই মুখপাত্র আরও বলেন, ক্ষমতাচ্যুত নেতার অবস্থান ছিল অস্থায়ী। তিনি কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান-ওচা সাংবাদিকদের জানান, মানবিক কারণে রাজাপক্ষেকে দেশটিতে ঢোকার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁর গতিবিধি সীমিত করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে শ্রীলঙ্কার ভেতরে সমর্থকেরা গোতাবায়াকে ফিরিয়ে নিতে নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের ওপর চাপ দিচ্ছিলেন। গত ১৯ আগস্ট রাজাপক্ষের ভাই ও শ্রীলঙ্কার সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপক্ষে গোতাবায়াকে নিরাপদে ফেরানোর অনুরোধ জানান। রাজাপক্ষের দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) পক্ষ থেকে এই অনুরোধ জানানো হয়। পার্লামেন্টে এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এসএলপিপি এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের দলের প্রধান দাবি ছিল শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা।
এখন কী হচ্ছে
শ্রীলঙ্কা অর্থনীতি পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ২৯০ কোটি ডলার সহায়তা (বেল আউট) পাবে। চার বছরের এই কর্মসূচির লক্ষ্য দেশটিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো। সরকারি রাজস্ব বাড়ানো ও বৈদেশিক রিজার্ভ পুনর্গঠন করা।
তবে আইএমএফ এখনো ঋণ অনুমোদন করেনি। শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজাপক্ষে ফিরে আসায় দেশের পরিস্থিতি আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে কি না, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
২১ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে শপথ নেওয়ার সময় থেকে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দমন করেছে। জনগণের সম্পদ নষ্ট করায় অনেককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে অধিকারকর্মী ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা।
মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী সাথকুনানাথান বলেছেন, রাজাপক্ষে ফিরে আসায় আবার বিক্ষোভ হওয়া নিয়ে ভয় রয়েছে। জীবনযাপনের খরচ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে।
সাথকুনানাথান আরও বলেন, দেশে যখন লাখ লাখ মানুষ খাবার ও জ্বালানির সংকটে রয়েছে, তখন রাজাপক্ষের আয়েশি জীবনযাপনে আবারও বিক্ষোভ হতে পারে।
আইটিজেপির সুকা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নিয়ে সাবেক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সম্ভাবনা কম। রাজনৈতিক মিত্রশক্তি তাঁকে সুরক্ষিত করবেন। তবে তিনি এমনও বলেছেন, নাগরিক সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করতে আদালতে আবেদন করবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল ও পুলিশ এ ধরনের পদক্ষেপে সমর্থন করবে বলে আশা করা যায়। সব অভিযোগ থেকে গোতাবায়াকে অব্যাহতি দিলে তা কেউ মেনে নেবে না। গোতাবায়ার প্রতি আইনি পদক্ষেপে বিশ্ব ও শ্রীলঙ্কাবাসী বুঝতে পারবে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।