কঠোর অনুশাসনের ইরানে নারীর বিদ্রোহ
ইরানের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের একটি তথ্য দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। দেশটির রাজধানী তেহরানসহ এর আশপাশের শহরগুলোয় বায়ুদূষণ এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে বাধ্য হয়ে সেখানকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে।
এর সঙ্গে ইরানের আরও দুটি চিত্র যোগ করা যেতে পারে—দেশটির তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩০–এর কাছাকাছি এবং মূল্যস্ফীতি প্রায় ৪০ শতাংশ। যেন এক বিষণ্ন দেশ। কিন্তু এ দেশের নারী, তরুণ-তরুণীরা জেগে উঠেছেন। তাঁরা সংস্কার চাইছেন। দমন-পীড়নেও তাঁদের কাবু করা যায়নি।
ইরানে সম্প্রতি তারুণ্যের উত্থানের পেছনের ঘটনাটি মোটামুটি এখন সবারই জানা। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে কুর্দিস্তান অঞ্চলের তরুণী মাসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ, তাঁর বেশভূষা আইন অনুসারে সঠিক ছিল না। নীতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। পরদিন তাঁর দাফনের সময় থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়।
কুর্দিস্তানের সাকেজ শহরে প্রথম এই বিক্ষোভ হয়। সেখানে মাসা আমিনির বাড়ি। এই বিক্ষোভ প্রথমে তেহরানসহ ইরানের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ইরানি নারীদের স্বাধীনতার দাবিতে কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা শহরে। বিক্ষোভে শামিল হন ইরানের শিল্পী, খেলোয়াড়সহ সর্বস্তরের মানুষ। শামিল হন বিভিন্ন দেশের শিল্পীরাও।
ইরানের তরুণ-তরুণীরা এই বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বয়সের বাধা পেরিয়ে, দেশের সীমানা পেরিয়ে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিক্ষোভ এত শক্তি পেল কোথা থেকে? ইরানের পক্ষ থেকে এই জবাব ক্লিশে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, এই বিক্ষোভে পশ্চিমাদের ইন্ধন রয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিও একই কথা বলেছেন। ষড়যন্ত্রে পশ্চিমাদের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী ইসরায়েলকেও দায়ী করেছেন ইরানের নেতারা।
কিন্তু এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? বিদেশি শক্তির ইন্ধনে মানুষ রাস্তায় নেমে জীবন দিয়ে দেবে, এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? যে আন্দোলনের কোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি নেই, সেই বিক্ষোভে বিদেশি শক্তির ইন্ধন কতটুকু থাকতে পারে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের জবাব ইরান সরকার দিয়েছে বুট ও বুলেটে। মূলত প্রতিদিন রাতে বিক্ষোভ হয়েছে।
আর সেই বিক্ষোভ দমনে স্বৈরতান্ত্রিক আদলে গড়ে ওঠা সরকার যা করে, তা–ই করেছে ইরান সরকার। এই বিক্ষোভ যাতে খুব বেশি বাড়তে না পারে, সেই জন্য ইন্টারনেট–সেবা বন্ধ করে দিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করেছে, গুলি চালিয়েছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার করেছে। তরুণদের দমনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অভিযান চালিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আহত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তারুণ্যকে দমিয়ে রাখা যায়নি।
ভয়াবহ নির্যাতনেও অবিচল বিক্ষোভকারীরা
সেপ্টেম্বরে মারা যাওয়া মাসা আমিনি যেন শত মুখ হয়ে ফিরে এসেছেন ইরানের প্রতিটি নগরে। প্রতি রাতে নারীরা বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভে স্লোগান দিয়েছেন। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্কুলের মেয়েশিশুরা হিজাব খুলে ফেলে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে।
বিক্ষোভ দমনে ঠিক কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তা জানা কঠিন। কারণ, সরকারের তরফ থেকে এক রকম তথ্য দেওয়া হয়েছে। আবার বেসরকারি সংস্থাগুলো ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। নভেম্বরের শেষ দিকে মানবাধিকার সংস্থা ইরানিয়ান হিউম্যান রাইটস জানিয়েছিল, তখন পর্যন্ত বিক্ষোভে প্রাণ গেছে প্রায় ৫০০ জনের। এর মধ্যে ৬০টি শিশু রয়েছে।
তবে ওই সময় আধা সরকারি ইরানি বার্তা সংস্থা মেহর জানিয়েছিল, মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০-এর আশপাশে। আহত হয়েছেন কত বিক্ষোভকারী, তার হিসাব নেই। আর গ্রেপ্তারের সংখ্যা? হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্ট নিউজ এজেন্সির তথ্য অনুসারে, ১৮ হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই বিক্ষোভকারীদের নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। সেখানকার চিকিৎসক, নার্সদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ইরানে নারী বিক্ষোভকারীদের মুখ ও যৌনাঙ্গ লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। তুলে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে অহরহ। এমনকি বিক্ষোভের জেরে শিশু ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে। এরপরও নারীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমেছেন। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পদত্যাগ চেয়েছেন, রাষ্ট্রের সংস্কার চেয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে, এক তরুণীর মৃত্যু কেন এতটা নাড়া দিচ্ছে ইরানের তরুণ প্রজন্মকে? এর জবাবে আসে সুবিধাবঞ্চিত তরুণ প্রজন্মের কথা। ৩০ শতাংশ বেকারত্ব ও ৪০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির ক্ষোভের উদ্গিরণ যেন ঘটেছে এই বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারী অধিকার। শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার নামে সেখানে বারবার এই মানবাধিকার পদদলিত হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছে সমাজের একটি বড় অংশ।
‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’
ইরানজুড়ে এমন বিক্ষোভ এবারই প্রথম তা নয়। দেশটির দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র ২০১৭ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এই বিক্ষোভ ছড়িয়েছিল ১৬০টি শহরে। বলা হয়ে থাকে ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর সবচেয়ে বড় বিক্ষোভটি হয়েছিল সেই সময়।
১০ দিনের বিক্ষোভে ৫০ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয় সরকারি বাহিনীর হাতে। জ্বালানির দাম বাড়ার প্রতিবাদে ২০১৯ সালে ইরানের মানুষ আবারও রাস্তায় নামেন। সেই সময় বিক্ষোভ দমনে বরাবরের মতো সরকার আবারও রেভল্যুশনারি গার্ড ও পুলিশকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়।
এতে প্রাণ হারায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ। এই বিক্ষোভকে ‘রক্তাক্ত নভেম্বর’ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। যা কিনা অতীতের যেকোনো বিক্ষোভকে ছাড়িয়ে যায়। ইরানের লেখক মেহদি খালাজির মতে, এই বিক্ষোভে দমন-পীড়ন সরকারের সত্যিকারে বর্বরতার মুখোশ উন্মোচন করেছিল।
এবারও সরকারের বর্বরতা প্রকাশ পেয়েছে। এর জেরে পশ্চিমা বিশ্ব নতুন করে ইরানের ওপর ততোধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে ইরান সরকারকে তার অবস্থান থেকে টলানো যায়নি। রাস্তায় গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি ক্ষমতাসীনেরা। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিচার শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ৬০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে এবারের বিক্ষোভের জেরে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আহ্বান উপেক্ষা করেই এসব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। এই বিক্ষোভ শুরুর পরই দেশটির আইনপ্রণেতারা আন্দোলন দমনে দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেটাই এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আন্দোলনে গেলে সরকার বর্বর হবে, এটা জেনেই রাস্তায় নেমেছিলেন ইরানের মানুষেরা। তবে এবার শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নয়। বিষণ্ন শহর, বিষণ্ন দেশের মানুষেরা রাস্তায় নেমেছিলেন নিজেদের মুক্তির জন্য। বিক্ষোভের মূল স্লোগান ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। আক্ষরিক কিংবা বাস্তবিক অর্থে সেই মুক্তি এখনো আসেনি। কিন্তু যে নীতি পুলিশের হাতে মাসা আমিনির প্রাণ গেছে, সেই নীতি পুলিশ বিলুপ্ত হয়েছে।