জি–৭ শীর্ষ সম্মেলনে গুরুত্ব পাচ্ছে ইউক্রেন ও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ইস্যু
আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক পর্যায়ের যেকোনো শীর্ষ সম্মেলন সাধারণত বিশেষ কিছু নিয়ম অনুসরণ করে অনুষ্ঠিত হয়। সেরকম একটি নিয়ম হচ্ছে শেষ দিনে সবরকম আলোচনার শেষে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর সম্মেলনের ঘোষণা প্রচার করা। এর মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি ঘটে নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য সমবেত সাংবাদিক সহ অন্যান্যদের কর্মব্যস্ততার।
তবে জাপানের হিরোশিমা শহরে আয়োজিত এবারের জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন সেদিক থেকে ইতিমধ্যে ব্যাতিক্রমী হয়ে উঠেছে। শীর্ষ সম্মেলন শেষ হবে আজ রোববার সভাপতি রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসাবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখার মধ্যে দিয়ে। হিরোশিমা শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণা একদিন আগে, গতকাল শেষ বেলায় সেটি প্রচার করা হয়।
বলা হচ্ছে, ইউক্রেন সংকট ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে আরও কিছুটা কোণঠাসা করার প্রয়াস হিসেবে এটা করা হয়েছে। জাপানের কিছু সংবাদমাধ্যমও সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এ অনুমান সঠিক হলে বলা যায়, হিরাশিমা শীর্ষ সম্মেলন সার্বিক অর্থেই হয়ে উঠেছে একক অ্যাজেন্ডার সম্মেলন। অন্য যেসব প্রসঙ্গ সেখানে উত্থাপিত এবং আলোচিত হয়, সেগুলো এসেছে সহায়ক প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে। সেদিক থেকে এ শীর্ষ সম্মেলনকে সার্বিক অর্থে সফল সম্মেলন আখ্যায়িত করা যায় না।
সম্মেলনজুড়েই জি-৭ নেতারা পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের লক্ষ্য অর্জনে নিরস্ত্রীকরণ ও পরমাণু বিস্তার রোধে চালানো প্রচেষ্টা জোরদার করার কথা বলেন। আবার চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ইউক্রেনকে সাহায্য করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। ইউক্রেনকে যে সাহায্য পশ্চিমা বিশ্ব দিচ্ছে, তার সিংহভাগ হচ্ছে সর্বাধুনিক অস্ত্র সরবরাহের সাহায্য। তবে এই অস্ত্র পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে জি-৭ নেতাদের পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলায় জানানো আহ্বানকে দ্বিমুখী আচরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সম্মেলনে আলোচনার মধ্য দিয়ে ইউক্রেন সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজা হয়নি। তবে যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। চীন যে শান্তি প্রস্তাব দিয়েছে, তা নিয়ে নেতারা নিশ্চুপ থেকেছেন।
সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে। তবে চীনকে নিয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। এর পেছনে মূলত আছে জোটের ইউরোপীয় সদস্যদের অনাগ্রহ।
ইউরোপের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কে যথেষ্ট গভীর। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কারণে ইতিমধ্যে বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে রয়েছে ইউরোপ। ইউরোপ এ অবস্থায় চীনের সঙ্গে সংঘাত চায় না। কারণ, এতে ইউরোপ আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে।
চূড়ান্ত ঘোষণায় চীন ও তাইওয়ান সংঘাত নিয়ে যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে চীনের সঙ্গে গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্কে গড়ে নিতে জোট প্রস্তুত আছে। জোট তাইওয়ান-চীন সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে। চীনের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে জি-৭–এর ইউরোপীয় সদস্যরা আগ্রহী।
তবে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে চীনের প্রতি নমনীয়তা দেখানো হলেও অন্যদিকে চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষ করে তিব্বত ও সিনজিয়াং অঞ্চলে বাধ্যতামূলক শ্রম নিয়ে ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিস্তৃত সমুদ্র তৎপরতা পরিচালনা ও সমুদ্রসীমার মালিকানা দাবির বিরোধিতা করে বলা হয়েছে যে সে রকম দাবির আইনগত কোনো বৈধতা নেই। অন্যদিকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য চূড়ান্ত ঘোষণায় উত্তর কোরিয়াকে দায়ী করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির লাগামহীনভাবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ অব্যাহত রাখার নিন্দা করা হয়।
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণা কেবল রাজনৈতিক বিষয়াবলির ওপরই আলোকপাত করেনি। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, লিঙ্গসমতা থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং ডিজিটাল সমস্যার মতো বিস্তৃত নানা রকম দিকের ওপর আলোকপাত করে বেশ কিছু সুপারিশ সব কটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে।
শীর্ষ সম্মেলনে গতকাল জি-৭ নেতারা আমন্ত্রিত আটটি আউটরিচ দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সেই বৈঠকে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়নি।
জাপানের স্থানীয় সময় আজ বেলা আড়াইটায় প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা সম্মেলনের অর্জন নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেবেন এবং উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। আর এর মধ্যে শেষ হবে হিরোশিমা জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন।