৭০০ কোটি টাকার ৩৩তলা ভবন মুহূর্তে তিনতলার সমান ধ্বংসস্তূপ

ধসে পড়া নির্মাণাধীন ৩৩তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপের পাশে উদ্ধারকর্মীরা। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে, ২৮ মার্চ ২০২৫ছবি: রয়টার্স

ব্যাংককের আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। অস্তরাগের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এই আবহে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ভূমিকম্পে ধসে পড়া একটি নির্মাণাধীন ৩৩তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন কয়েক শ উদ্ধারকর্মী।

আকাশের কমলা রঙের আভার নিচে এই দৃশ্যের অদূরে একটি সেতুতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের একটি দল। একটি নির্মাণাধীন ৩৩তলা ভবন মুহূর্তে তিনতলার সমান একটি কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হয়েছে, এটা আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

কিন্তু সামান্য দূরে চোখের সামনেই তো বাঁকানো তার ও ধাতুর উপাদান বের হয়ে আছে।

এরই মধ্যে আরও বেশি পেশাদার উদ্ধারকারী ও সামরিক বাহিনীর দল এসেছে। জ্বালানো হয়েছে ফ্লাডলাইট। কিন্তু জীবিত কোনো ব্যক্তিকে উদ্ধারের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ বলে মনে হচ্ছে।

মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলের মান্দালয়ে গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। ১১ মিনিটের মাথায় সেখানে ৬ দশমিক ৪ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল অগভীর হওয়ায় কম্পনের তীব্রতা বেশি ছিল। প্রতিবেশী থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, চীন ও ভারতেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপির খবর অনুযায়ী, ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে ১৪৪ জন নিহত এবং ৭৩২ জন আহত হয়েছেন বলে দেশটির জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং জানিয়েছেন। তিনি যেকোনো দেশ ও সংগঠনের সহায়তা চেয়েছেন। রাজধানী নেপিডোসহ মিয়ানমারের ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

মিয়ানমারের ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে অনেক ভবন ধসে গেছে, রাস্তাঘাট চৌচির হয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

ভূমিকম্পের পর অফিস ও বাসাবাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এসেছেন মানুষ। ব্যাংকক, ২৮ মার্চ ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় ১ হাজার ২০ কিলোমিটার দূরের ব্যাংককে তীব্র কম্পন অনুভূত হয়েছে। ব্যাংককের ধসে পড়া এই ৩৩তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে অন্তত ১১৭ জন শ্রমিক চাপা পড়েছেন। এত ব্যাপক মাত্রার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে থাইল্যান্ডবাসী পরিচিত নন। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ভূমিকম্পের সময় আমি আমার বাসায় ছিলাম। এই রকম কোনো কিছু আমি আগে অনুভব করিনি।

ধসে পড়া ভবনটি জাতীয় নিরীক্ষা অফিসের। তিন বছর ধরে ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছিল। এতে ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি থাই বাথ বা সাড়ে ৪ কোটি পাউন্ডের বেশি অর্থ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি।

ধসে পড়া ভবনের আশপাশের এলাকায় অনেকগুলো তাঁবু খাটানো হয়েছে। উজ্জ্বল হলুদ হ্যাট পরা উদ্ধারকর্মীরা হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। আকাশচুম্বী ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে তাঁরা ১১৭ জনকে উদ্ধারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।

থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত তিন ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রায় এক ঘণ্টা আগে দুটি মরদেহ তাঁবুতে আনতে দেখেছি আমি।’

ধসে পড়া ৩৩তলা নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা
ছবি: এএফপি

ধসে পড়া ভবনের পাশের সড়ক অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত অন্যান্য গাড়িতে ভরা। সেতুতে আমাদের সঙ্গে কিছু উৎসুক মানুষও যুক্ত হয়েছেন। কী ঘটছে, তা তাঁরাও বুঝতে চেষ্টা করছেন।

আরও পড়ুন

একটি বড় ক্রেনসহ অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি আনা শুরু হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনুসন্ধান শুরু করার আগে ধ্বংসস্তূপের জঞ্জাল সরাতে হবে।

এই ভবন ধসে পড়ার এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে আমি ঘটনাস্থলে আসি। এসে দেখি, নির্মাণশ্রমিকেরা ধুলায় জবুথবু হয়ে আছেন। বেঁচে যাওয়ায় তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন।

বেঁচে যাওয়া একজন শ্রমিকের নাম অ্যাডিসর্ন কামফাসর্ন। ভূমিকম্পের সময় তিনি ছয়তলা থেকে নিচে জিনিসপত্র নামাচ্ছিলেন। হঠাৎ কম্পন অনুভব করে ১৮ বছর বয়সী এই শ্রমিক সিঁড়ির দিকে তাকান এবং একটি ক্রেন কাঁপতে দেখেন।

অ্যাডিসর্ন আমাকে বলেন, ‘আমি বুঝতে পারলাম, খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি দৌড় দিলাম। এক মিনিটের মধ্যে ভবনটি ধসে পড়ল। মুহূর্তেই সবকিছু ঘটে গেছে। সবখানে ধোঁয়া, সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমার কোনো মাস্ক ছিল না।’

আরও পড়ুন
শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বহুতল ভবন। ব্যাংকক, থাইল্যান্ড। গতকাল শুক্রবার, ২৮ মার্চ
ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

মুঠোফোন হারিয়ে ফেলায় তিনি এখনো তাঁর পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তিনি এর আগে জীবনে এমন ভয়াবহ কোনো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাননি। তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি মারা যাচ্ছেন।

ওই নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করেন—এমন কয়েকজন শ্রমিক আমাকে বলেছেন, শ্রমিকদের মধ্যে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের নাগরিক রয়েছেন।

ভূমিকম্পের সময় নুকুল খেমুথা (৩০) নামের এক শ্রমিক ওই ভবনের পঞ্চম তলায় কাজ করছিলেন। হঠাৎ ধাক্কা অনুভব করে তিনি তাকিয়ে দেখেন, পুরো ভবন ডুবে যাচ্ছে, অনেকগুলো গর্ত হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

নুকুল খেমুথা বলেন, কিছুক্ষণ আগে তাঁর এক সহকর্মী দশম তলায় বাথরুমে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁর খবরের অপেক্ষায় আছেন। নুকুল খেমুথা আরও বলেন, ‘আমরা সবাই চিৎকার করে বলতে শুরু করি “দৌড়াও”। সবাইকে একে অপরের হাত ধরতে বলি এবং একসঙ্গে দৌড়াতে বলি।’

আমি যখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন তাঁরা ধূমপান করে নিজেদের শান্ত করতে চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। বেঁচে যাওয়াদের কেউ কোনো চিকিৎসাসহায়তা নেননি। কারণ, আটকা পড়া মানুষদের দিকেই তাঁদের পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ রয়েছে।

এদিকে ড্রিলিংয়ের শব্দ তীব্রতর হচ্ছে। উদ্ধারকর্মীদের সামনে পড়ে আছে একটি দীর্ঘ রাত।

পানিসা আমোচো থাইল্যান্ডে বিবিসি নিউজের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।