চিন রাজ্য ‘মুক্ত’ করার দাবি বিদ্রোহীদের

মিয়ানমারের বড় একটি অঞ্চল এখন বিদ্রোহীদের দখলেফাইল ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলের চিন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছেন দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীরা। ওই অঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ব্রাদারহুড গত সোমবার দাবি করে, সপ্তাহান্তে মিনদাত ও কানপেটলেট শহর দুটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় চিন রাজ্যের ৮০ শতাংশই জান্তার হাতছাড়া হয়ে গেছে।

চিন ব্রাদারহুডের মুখপাত্র ইয়াও ম্যাং ইরাবতীকে জানান, সশস্ত্র এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চল জান্তার কাছ থেকে মুক্ত করেছে। এখন বিদ্রোহীরা উত্তরাঞ্চলের ফালাম শহরে জান্তার সর্বশেষ অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, রাজধানী হাক্কা, ফালাম, তেদিম ও থানটালাং শহরে জান্তার চলাচল সীমিত হয়ে গেছে। এর বাইরে পালেতাওয়া, মাতুপি, কানপেটলেট, মিনদাত মুক্ত হয়েছে। কানপেটলেট ও মিনদাত থেকে গত রোববার সকালে ১৩ জন রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্ত করা হয়েছে।

জান্তাবিরোধী চিন ব্রাদারহুড নামের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে ইয়াও ডিফেন্স ফোর্স, স্যাগাইন অঞ্চলের গ্যাংগাও জেলার ইয়াও আর্মি ও মনিওয়া পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের সদস্যরা রয়েছেন। এই গোষ্ঠীগুলো একযোগে চার মাস আগে থেকে জান্তার বিরুদ্ধে মিনদাত, ফালাম ও কানপেটলেট মুক্ত করার অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করে। অপারেশন সিবি নাম দিয়ে তারা ৯ নভেম্বর থেকে অভিযান শুরু করে।

চিন ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে গত শুক্রবার জানানো হয়, তাদের আক্রমণের মুখে ১৬৮ জান্তা সেনা ও পুলিশ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এ নিয়ে ব্যাপক অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৩০০ জান্তা তাদের হাতে বন্দী হয়েছে।

চিন ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাখাইনের আরাকান আর্মি তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছে।

এদিকে গত শুক্রবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আঞ্চলিক সেনা সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করে রাজ্যটির জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এর মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে দ্বিতীয় কোনো আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারায় ক্ষমতাসীন জান্তা।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ড রয়েছে ১৪টি। এসব কমান্ডের অধীন নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর আগে গত আগস্টে চীন সীমান্তবর্তী শান রাজ্যের রাজধানী লাশিওতে অবস্থিত উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা। এটি ছিল বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়া প্রথম কোনো আঞ্চলিক সেনা কমান্ড।

গত বছরের নভেম্বরে রাখাইনে জান্তা বাহিনীর ঘাঁটি ও অবস্থান নিশানা করে বড় পরিসরে হামলা শুরু করে আরাকান আর্মি। এরপর থেকে রাজ্যটির ১৭টি শহরের ১২টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিদ্রোহীরা। অন্য শহরগুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে। এ ছাড়া পাশের শান রাজ্যের সীমান্তবর্তী শহর পালেতোয়ার নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে আরাকান আর্মি।

সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সীমান্ত–লাগোয়া শহর মংডুর নিয়ন্ত্রণ নেয় আরাকান আর্মি। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৭০ কিলোমিটার সীমান্ত পুরোপুরি আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। এখন শুধু রাজ্যটির রাজধানী সিত্তে জান্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক অভ্যুত্থানে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তখন থেকেই দেশটিতে অস্থিরতা চলছে। সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। গণবিক্ষোভে হাজার মানুষ নিহত হলে তা রূপ নেয় সশস্ত্র লড়াইয়ে। এরপর সশস্ত্র এই লড়াইয়ে বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যোগ দেয়।

আরও পড়ুন

গত বছরের ২৭ অক্টোবর তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী জোটবদ্ধভাবে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় পরিসরে অভিযান শুরু করে, যা ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে বেশি পরিচিত। এ জোটে আরাকান আর্মি ছাড়াও রয়েছে কোকাং অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও শান রাজ্যের তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)।

এর এক বছর পর গত নভেম্বরের মাঝামাঝি মিয়ানমারের ১৪ হাজারের বেশি গ্রাম নিয়ে একটি জরিপ করে বিবিসি। এসব গ্রাম কাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তা যাচাই করে দেখা হয়েছে ওই জরিপে। দেখা গেছে, সংঘাত শুরুর প্রায় চার বছর পর মিয়ানমারের মাত্র ২১ শতাংশ ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আর ৪২ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে জাতিগত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। বাকি অঞ্চলগুলোয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াই চলছে।

আরও পড়ুন