মিয়ানমারের ভূমিকম্পে ‘৩৩৪ আণবিক বোমার’ শক্তি: ‘আমাদের উদ্ধারে কেউ আসেনি’
মিয়ানমারে গত শুক্রবারের শক্তিশালী ভূমিকম্প নতুন করে দুর্দশা বয়ে এনেছে। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের আগে থেকেই নানা বিপত্তিতে ছিল দেশটি। সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে গৃহযুদ্ধ। সামরিক জান্তা ক্ষমতায় বসার পর বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমার।
মিয়ানমারে ২০২১ সালে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় বসে সামরিক জান্তা। এরপর থেকেই দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গণতন্ত্রপন্থী যোদ্ধা এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহীদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। এতে করে দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থার বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবারের ভূমিকম্পে মিয়ানমারে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার প্রকৃত চিত্রটা পাওয়া কঠিন।
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে শনিবার পর্যন্ত দেশটিতে ১ হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এমনকি প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যাটা জানতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের ভূমিকম্প নিয়ে কী জানা গেল—
ঐতিহাসিক এক শহরে সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতি
ভূমিকম্পে মিয়ানমারের ঐতিহাসিক শহর মান্দালয় শহরে ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র শনিবার সামনে এসেছে। এই শহরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে মান্দালয় সবচেয়ে কাছের শহর।
বৌদ্ধ মঠ এবং মিয়ানমারের রাজবংশের সুবিশাল প্রাসাদের জন্য মান্দালয় পরিচিত। শহরটির বাসিন্দারা সিএনএনকে বলেছেন, ভূমিকম্পে শহরের ঘরবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, মসজিদ ও মঠ ধসে পড়েছে। ফেটে গেছে বিভিন্ন সড়ক। একজন ভূতাত্ত্বিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবারের ভূমিকম্পের সময় ৩৩৪টি আণবিক বোমার সমান শক্তি নির্গত হয়েছে।
সাবেক আইনজীবী সিএনএনকে জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে তাঁর স্ত্রীর পরিবারের তিন সদস্য মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আমরা তাঁদের মরদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করতে পারিনি।’
ভূমিকম্পের পর থেকেই আহতদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন মান্দালয়ের বাসিন্দারা। নিখোঁজ বা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া প্রিয়জনের শেষ খবর কী, তা জানতে অপেক্ষা করছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে এক নারীর সিএনএনের কাছে তুলে ধরেছেন, তাঁর পরিবারের এক সদস্যের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ার কথা।
৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের সময় মান্দালয়ের ওই নারী তাঁর শিশু সন্তানের জন্য দুধ বানাচ্ছিলেন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পটি খুবই শক্তিশালী ছিল। দ্রুত সবকিছু ঘটে যায়।’ এতে ওই নারীর বাড়ির একটি দেয়ালের অংশ ভেঙে তাঁর দাদির ওপর পড়ে। তাঁর দুই পা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে।
ভূমিকম্পের সময়ের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে ওই নারী বলেন, ‘ঘরের দরজা খুলছিল না, কারণ, একটি দেয়াল সেটির ওপরে এসে পড়েছিল। আমি সাহায্যের জন্য চিৎকার করলাম। তখন আমার স্বামী রাস্তা থেকে ছুটে এল। সে দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কোনোমতে খুলল।’
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে শহরের একজন সাবেক আইনজীবী সিএনএনকে জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে তাঁর স্ত্রীর পরিবারের তিন সদস্য মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আমরা তাঁদের মরদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করতে পারিনি।’
জুমার নামাজের সময় ধসে পড়ে অনেক মসজিদ
শুক্রবার যখন ভূমিকম্প হয়, তখন মান্দালয়ের অনেক মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করা হচ্ছিল। শক্তিশালী কম্পনে কিছু মসজিদে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শহরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘যখন ভবনগুলো ধসে পড়ছিল, ভেতরে অনেক মুসলিম আটকা পড়েন। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে... একটি মসজিদে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।’
মান্দালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইরাবতী নদীর ওপারে সাগাইং অঞ্চলেও ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়ি কাঠ ও খড়ের তৈরি। সেগুলো ভূমিকম্পের সময় কম ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানকার বাসিন্দা ৩৪ বছর বয়সী নাং আয়া ইয়িন জানতে পারেন, তাঁর এক আত্মীয় ওপর একটি ভবন ধসে পড়েছে। ওই ভবনে তখন তিনি পড়াশোনা করছিলেন।
মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ১০ বছরের মতো গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। এর আগে দশকের পর দশক ধরে সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা দেশটি শাসন করেছে।
নাং আয়া ইয়িন বলেন, ‘সৌভাগ্যবশত কেউ মারা যায়নি। তবে দুজন গুরুতর আহত হয়েছে। ১১ বছর বয়সী আমার এক ভাগনি তিনটি আঙুল হারিয়েছে। আরেকজনের মাথা ও একটি পায়ের হাড় ভেঙে গেছে।’ তিনি বলেন, মান্দালয় ও সাগাইংয়ের হাসপাতালগুলো থেকে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, সেখানে চিকিৎসা দেওয়া মতো আর জায়গা নেই।
এরই মধ্যে বেসামরিক লোকজন এবং উদ্ধারকর্মীরা অভিযোগ তুলছেন—ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য ভারী সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের কাছ থেকেও আশা অনুযায়ী সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
মান্দালয়ের বেসামরিক লোকজন জানিয়েছেন, বাধ্য হয়ে তাঁদের খালি হাতে উদ্ধারকাজে নামতে হয়েছে। ভূমিকম্পের বেঁচে ফেরা একজন রয়টার্স বলেন, ‘শহরের সবখানে শুধু ধ্বংসস্তূপ। আর আমাদের উদ্ধারের জন্য কোনো উদ্ধারকারী দল এগিয়ে আসেনি।’
বিদেশি সহায়তার জন্য বিরল আহ্বান
মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ১০ বছরের মতো গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। এর আগে দশকের পর দশক ধরে সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা দেশটি শাসন করেছেন। এ সময় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সাধারণ তাঁরা বিদেশি সহায়তা এড়িয়ে চলেছেন এবং দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম করে দেখিয়েছেন।
তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ব্যতিক্রমী পথ ধরে দ্রুত বিদেশি সহায়তা চেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার তিনি মান্দালয় শহরের ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শন করেছেন। রাজধানী নেপিডোর উপদ্রুত এলাকায়ও সফর করেছেন তিনি।
শনিবারই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের উদ্ধারকারী দল ও সহায়তা পাঠানো শুরু করেছে। জান্তা সরকারের ঘনিষ্ঠ অংশীদার চীন থেকে একটি দল ত্রাণ সহায়তা নিয়ে ইয়াঙ্গুনে পৌঁছেছে। পাশপাশি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত ও রাশিয়াও সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। তবে ইয়াঙ্গুন থেকে মান্দালয়ের দূরত্ব প্রায় ৩৮০ মাইল। সেখানে এই সহায়তা কবে পৌঁছাবে তা অনিশ্চিত।
‘পৃথিবীর বুকে ছুরির বড় আঘাত’
শুক্রবারের ভূমিকম্প ছিল মিয়ানমারের গত এক শতকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। ভূতাত্ত্বিক জেস ফিনিক্স সিএনএনকে বলেন, ‘এ ধরনের ভূমিকম্পে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা প্রায় ৩৩৪টি আণবিক বোমার সমান’। আরেকজন ভূমিকম্পবিদ বলেছেন, শুক্রবারের ভূমিকম্প ছিল ‘পৃথিবীর বুকে ছুরির বড় আঘাতের’ মতো।
যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস জ্যাকসন সিএনএনকে বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পটি একটি ফাটলের কারণে হয়েছিল, যেটি ‘পুরো এক মিনিট’ ধরে স্থায়ী ছিল। এর ফলে আশপাশের ভূপৃষ্ঠে কম্পন হয়। তিনি বলেন, ‘মনে করুন একটি কাগজ ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। আর সেটি ছেঁড়া হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে দুই কিলোমিটার গতিতে।’