মুঠোফোন বেজে চললেও কোনো জবাব আসছে না: ভবনের বাইরে উদ্বিগ্ন স্বজনদের অপেক্ষা
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বাঁকানো তার ও ধাতুর ধ্বংসস্তূপ সরাতে ব্যস্ত শত শত উদ্ধারকর্মী। এসব জঞ্জালের সামান্য দূরে অপেক্ষা করছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁদের কারও বোন, কারও ভাই, কারও মা, কারও স্বামী বা কারও সহকর্মী মুহূর্তে ধসে পড়া নির্মাণাধীন ৩৩ তলা ভবনের নিচে চাপা পড়েছেন। এতে শতাধিক শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চল মান্দালয়ের কাছে গত শুক্রবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ৭ দশমিক ৭ তীব্রতার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ১১ মিনিটের মাথায় সেখানে ৬ দশমিক ৪ তীব্রতার আরেকটি পরাঘাত (আফটার শক) হয়। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল অগভীর হওয়ায় কম্পনের তীব্রতা বেশি ছিল।
মিয়ানমারের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড। এ ছাড়া বাংলাদেশ, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ-পশ্চিম চীন ও ভারতে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
গতকাল শনিবার মিয়ানমারের জান্তা সরকার জানায়, ভূমিকম্পে ১ হাজার ৬৪৪ জনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪০৮ জনের বেশি। তবে পরিসংখ্যানের বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে ইউএসজিএস পূর্বাভাস করেছে, মিয়ানমারে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়াতে পারে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিণাম দেশটির বার্ষিক আর্থিক উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গতকাল ব্যাংককের ডেপুটি গভর্নর বলেছেন, ‘আমাদের শহরে অন্তত ১০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।’
‘আমি টানা কল করে যাচ্ছি’
ব্যাংককের নির্মাণাধীন ৩৩ তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপের এলাকাটি বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এখানেই বিখ্যাত সাপ্তাহিক চাটুচক বাজার অবস্থিত। প্রতিবছর এখানে লাখ লাখ বিদেশি পর্যটক আসেন।
গতকাল শনিবার সকালে চাটুচক বাজার এলাকায় নিখোঁজ স্বজনের সন্ধানে অপেক্ষা করছিলেন অনেকে। তাঁদের একজন জুনপেন কাউনোই। তাঁর মা ও বোন ধসে পড়া আকাশচুম্বী ভবনটিতে রঙের কাজ করতেন।
কাউনোই সিএনএনকে বলেন, ‘আমি টানা কল করে যাচ্ছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছি না। কল করে প্রতিবার আমি কেবল টো...টো...আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।’
কাউনোই বলছিলেন, ‘মনে হচ্ছে, আমার পেটে দলার মতো কিছু একটি হয়েছে। আমার খিদে চলে গেছে। গতকাল থেকে আমার মা ও বোন আটকা পড়ে আছেন, আমি তাঁদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁদের কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।’
কাজে যাওয়ার আগে শুক্রবার সকালে বোনের সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল কাউনোইর। তখন তিনি তাঁর কাছে ‘দুপুরে কী খাবে, তা জানতে চেয়েছিলেন’।
ব্যাংককের এ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে নগরের নানা সমস্যা নতুন করে সামনে এসেছে। এসব সমস্যার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সবচেয়ে বড়। ব্যাংককের নির্মাণশ্রমিকদের অধিকাংশই আসেন থাইল্যান্ডের গরিব অঞ্চলগুলো থেকে। বিশেষ করে কম ধনী উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে সেখানে অনেক শ্রমিক আসেন। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ লাওস, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার থেকেও অনেক শ্রমিক ব্যাংককে কাজ করতে আসেন।
চীনা নির্মাণপ্রতিষ্ঠান
ধসে পড়া ভবনটি নির্মাণ করছিল ‘চায়না রেলওয়ে নম্বর ১০ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের’ একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। চায়না রেলওয়ে নম্বর ১০ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (সিআরইসি) একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। সিআরইসি বিশ্বের বৃহত্তম নির্মাণ ও প্রকৌশল ঠিকাদারদের একটি। চায়না রেলওয়ে নম্বর ১০ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্ট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। পোস্টটি এরই মধ্যে মুছে দেওয়া হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ওই ভবন তৈরির প্রকল্পে ইতালীয়-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডও জড়িত ছিল।
চীনের বার্তা আদান-প্রদানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটের ২০২৪ সালের ২ এপ্রিলের একটি পোস্টে বলা হয়, চায়না রেলওয়ে নম্বর ১০ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ভবনটির মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ মূল অবকাঠামো তৈরির কাজ শেষ হয়েছিল।
একই পোস্টে আরও বলা হয়েছিল, ভবনটির কাজ শেষ হলে তা থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় অডিট অফিস এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করার কথা ছিল।
এই পোস্ট সিএনএনের দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু দুপুরে ভবনটি ধসে পড়ার পর পোস্টটির স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া শুরুর করলে শুক্রবার বিকেলে পোস্টটি মুছে দেওয়া হয়েছে। মন্তব্যের জন্য কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল সিএনএন।