মিয়ানমারে ভূমিকম্প: ৭ দিন পরও ধ্বংসস্তূপের পাশে গিয়ে স্বামীর নাম ধরে ডাকছেন স্ত্রী
মিয়ানমারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর এক সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়েছে। এখনো স্বামী ও দুই শিশুসন্তানের খোঁজে নির্ঘুম রাত কাটান হনিন। বিধ্বস্ত মান্দালয় শহরের যে ভবনের নিচে পরিবারের সদস্যরা চাপা পড়েছেন, সেখানে গিয়ে স্বামীর নাম ধরে ডাকাডাকি করেন। যদি কোনো সাড়া পাওয়া যায়। হনিন বলেন, পরিবারের সদস্যদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।
২৮ মার্চ মিয়ানমারে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মান্দালয়, সাগাইং ও রাজধানী নেপিডো। দেশটিতে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার আহ শনিবার জানিয়েছে, ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৫৪ জন নিহত হয়েছেন। সংখ্যাটা প্রতিদিনই বাড়ছে। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৫০ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২২০ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হনিনের স্বামী-সন্তানেরাও।
হনিনের মতো একই অবস্থা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোর বাসিন্দাদের। ঘরবাড়ি ধসে পড়ায় আর আবার ভূমিকম্পের আশঙ্কায় এখনো তাঁরা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। প্রচণ্ড গরমে অনেকেই হিটস্ট্রোকের শিকার হচ্ছেন। ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মরদেহ থেকে ভেসে আসছে দুর্গন্ধ। শৌচাগার ব্যবহার করতে পারছেন না অনেকে। এতে চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
মিয়ানমারের ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ ও মন্দিরের পাশাপাশি সরকারি ভবনগুলোরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে নেপিডোর সুপ্রিম কোর্ট ভবন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ভূমিকম্পে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই সরকারি কর্মচারীদের পরিবারের সদস্য—তাঁদের স্ত্রী, সন্তান ও মা-বাবা।
ভূমিকম্পে মিয়ানমারের সামরিক স্থাপনাগুলোর কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা প্রকাশ করেনি সরকার। তবে ভূমিকম্পের কারণে জান্তা বাহিনীর সদস্যরা নৈতিকভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছেন বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের গবেষক ইয়ে মিও হেইন। তাঁর ভাষ্যমতে, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেক সেনা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতে পারছেন না। শুধু নেপিডো নয়, মিয়ানমারে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত সব এলাকায় এই সমস্যার মুখে পড়ছেন তাঁরা।
বিধ্বস্ত এলাকা পুনর্গঠন নিয়ে শঙ্কা
জাতিসংঘের হিসাবে, ভূমিকম্পে মিয়ানমারের যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বসবাস। এই এলাকাগুলোয় অন্তত ১০ হাজার ভবন ধসে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক শহর এলাকা পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন পড়বে বিপুল পরিমাণ অর্থের।
২০২১ সালে মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে জান্তা সরকার। এর পর থেকে দেশটিতে চলছে গৃহযুদ্ধ। এমনকি ভূমিকম্পের পরও জান্তাবিরোধী বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর থেকেই দেশটি বিদেশি সহায়তা থেকে বিচ্ছিন্ন। এমনকি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড়ের সুযোগ নেই তাদের।
এমন পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত মিয়ানমারের পুনর্গঠন কীভাবে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হরসি বলেন, ভূমিকম্পে মিয়ানমারে অন্তত ২০টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু প্রকল্পের জন্য চীন হয়তো ঋণ দিতে পারে। তবে জান্তা সরকারকে বিশ্বাস করে বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, ভূমিকম্পের পর জরুরি সহায়তা কার্যক্রম ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারেনি তারা।
এদিকে ভূমিকম্পের পর চীন, রাশিয়া, ভারতসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশ সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছে। গতকাল মান্দালয় পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন জাতিসংঘের ত্রাণ ও মানবিক সহায়তাসংক্রান্ত সংস্থার (ওসিএইচএ) প্রধান টম ফ্লেচার। তিনি বলেন, বিশ্বকে মিয়ানমারের মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।