আর্থিক কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে বছর শেষ জাপানের প্রধানমন্ত্রীর
আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ জাপানের ক্ষমতাসীন উদার গণতান্ত্রিক দল এলডিপির জন্য নতুন কিছু নয়। স্বল্প সময়ের বিরতি দিয়ে ১৯৫৫ সাল থেকে প্রায় বিরতিহীনভাবে ক্ষমতায় থাকা দলটি অতীতেও নানা রকম আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিল। সে রকম অভিযোগের মুখে এর আগে দুইবার ক্ষমতা হারাতে হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় বিরোধীদের ব্যর্থতার মুখে ক্ষমতায় ফেরে দলটি। কিন্তু কেলেঙ্কারির ছাপ দলের নেতৃত্বের পেছনে যেন সব সময় লেগে থেকেছে।
এবারও যে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, সম্প্রতি ফাঁস হয়ে যাওয়া অর্থ সংগ্রহ নিয়ে ঘটনাবলি সেই প্রমাণ নিয়েই কেবল উপস্থিত হয়নি, একই সঙ্গে মন্ত্রিসভার শীর্ষ কয়েকজন সদস্যকেও কেলেঙ্কারির দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাকে কিছুটা বেসামাল অবস্থার মধ্যেই নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে হচ্ছে। আর কেলেঙ্কারির পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোন পথে গড়ায়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো বিরাজমান।
এবারের কেলেঙ্কারির পেছনে রয়েছে প্রধান ক্ষমতাসীন দলের উপদলীয় রাজনীতির নেপথ্যের কিছু দিক। এলডিপি একক পরিচয়ে পরিচিত হলেও শুরু থেকেই উপদলীয় বিভাজন রয়েছে দলে। যে উপদলের প্রতি সমর্থন যত বেশি, সেই উপদল বরাবর নেতৃত্বের লড়াইয়ে এগিয়ে থেকে মন্ত্রিসভার প্রধান পদগুলো নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি সবচেয়ে বড় উপদলটি ছিল প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন। দলের ভেতরে অবস্থানগত সেই সুবিধার কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী আবে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার পরও মৃত্যুর আগপর্যন্ত কার্যত ‘কিং মেকার’ হিসেবে দলের ভেতরে নিজের অবস্থান তিনি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আবের মৃত্যু সেই হিসাব কিছুটা পাল্টে দিলেও এখন পর্যন্ত আবের উপদল হচ্ছে এলডিপির সবচেয়ে বড় উপদল। তবে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় এই উপদলের নেতাদের ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকা নতুন এক সংকটের মধ্যে আবের উপদলকে ফেলে দিয়েছে। একই সঙ্গে এলডিপির সভাপতি হিসেবে এর সার্বিক দায়ভার প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার ওপরও এসে পড়েছে।
এবারের কেলেঙ্কারির পেছনে আছে তহবিল সংগ্রহের জন্য উপদলের আয়োজিত কিছু অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রিসংক্রান্ত অনিয়ম। জাপানের রাজনৈতিক দলগুলো সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবের ভিত্তিতে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলের কর্মপরিচালনায় সাহায্য করা হচ্ছে ভর্তুকির লক্ষ্য। তবে সমর্থকদের জন্য সারা বছর নানা রকম সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বাইরে দলের সাংগঠনিক সামর্থ্য বজায় রাখতে সেই অর্থ পর্যাপ্ত গণ্য না হওয়ায় অন্যান্য পথে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ দলগুলোর জন্য রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে অবশ্য অর্থের সঠিক হিসাব-নিকাশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। এর ব্যত্যয় হলে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার কর্তৃপক্ষের রয়েছে।
এলডিপির বিভিন্ন উপদল তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি করায় শীর্ষস্থানীয় সদস্যদের উৎসাহিত করতে এদের নানা রকম সুবিধা দিয়ে থাকে। যার একটি হচ্ছে নির্ধারিত কোটার অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি করতে সক্ষম হলে সংগৃহীত অর্থের একটি অংশ এদের দিয়ে দেওয়া। সরাসরি উৎকোচ হিসেবে এটাকে দেখা না হলেও এর পেছনে থেকে যাওয়া অন্য হিসাব-নিকাশকে অবশ্য উৎকোচ গ্রহণের আওতায় ফেলা যায়। কারণ, টিকিট যাঁরা বিক্রি করছেন, তাঁরা সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। এঁদের খুশি রাখতে সরকারের অনুগ্রহ পেতে আগ্রহী ব্যবসায়ী ও অন্যান্য মহল সে রকম টিকিট কিনে নিতে কোনো রকম কার্পণ্য করে না। তা সত্ত্বেও বৈধ নিয়মের আওতায় টিকিট বিক্রি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত অনিয়ম হিসেবে এটাকে দেখা হয় না। তবে অনিয়ম তখনই ঘটে, টিকিট বিক্রি থেকে হওয়া আয়ের হিসাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে রাজনীতিবিদেরা যখন ব্যর্থ হন। এবারের কেলেঙ্কারির ঘটনার মূলে আছে সেই হিসাব।
ছোট-বড় মিলিয়ে এলডিপিতে উপদল এখন আছে পাঁচটির মতো, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় উপদল হচ্ছে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর উপদল। আবের মৃত্যুর পর যে দুজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তাঁদের ক্ষমতা গ্রহণের পথ করে দেওয়ার পেছনেও বড় ভূমিকা রেখেছে সেই উপদল। তবে প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্য মন্ত্রিসভার সবচেয়ে প্রভাবশালী পদগুলোতে সেই উপদলের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। কিশিদা মন্ত্রিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত যেমন ছিলেন আবে উপদলের সদস্য, একই কাঠামো লক্ষ করা যায় কিশিদার পূর্বসূরি ইয়োশিহিদে সুগার মন্ত্রিসভাতেও।
এবার অবশ্য সরকারি কৌঁসুলির কার্যালয় আগবাড়িয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করায় থলের বিড়াল দ্রুত বের হয়ে পড়ে। ফলে শিনজো আবে উপদলের সব সদস্যকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়।
উপদলের স্থানীয় সমর্থন ভিত্তি ধরে রাখার জন্য স্থানীয়ভাবে নেওয়া নানা রকম উদ্যোগের বাইরে উপদলীয় কার্যালয় পরিচালনায় সরকারি ভর্তুকির অর্থ পর্যাপ্ত বিবেচিত না হওয়ায় তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি করার মধ্য দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা আইনগতভাবে অনুমোদিত। তাই উপদলীয় নেতারা প্রায়ই সে রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নির্ধারিতসংখ্যক টিকিটের বাইরে অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি করতে পারলে তাঁরা নিজেরাও লাভবান হন। তবে সেই আয়ের বৈধ হিসাব দাখিল করা হলে এর থেকে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ আয়কর হিসেবে পরিশোধ করতে হয় বলে এঁদের অনেককেই সেই হিসাব চেপে রাখতে দেখা যায়। এবারে অবশ্য সরকারি কৌঁসুলির কার্যালয় আগবাড়িয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করায় থলের বিড়াল দ্রুত বের হয়ে পড়ে। ফলে আবে উপদলের সব সদস্যকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়। তবে আবের উপদল একাই এ রকম অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না, প্রধানমন্ত্রী কিশিদার উপদলও একই অভিযোগে অভিযুক্ত, যদিও আর্থিক হিসাব এবং কেলেঙ্কারির ব্যাপ্তি সেই উপদলের বেলায় অনেকটাই সীমিত।
কেলেঙ্কারির তাৎক্ষণিক ফলাফলে কিশিদা এবং তাঁর মন্ত্রিসভার প্রতিজন সমর্থনের হারে দ্রুত ধস নামে। বার্তা সংস্থা কিওদোর চালানো সর্বশেষ জরিপে সমর্থন ২২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে যেতে দেখা যায়। অন্যদিকে প্রভাবশালী দৈনিক মায়নিচি শিম্বুনের চালানো সাম্প্রতিক জরিপে এই হার দেখানো হয়েছে ২১ শতাংশ। উভয় হিসাব প্রধানমন্ত্রীর জন্য সংকটের আভাস ফুটিয়ে তুললেও বিরোধী দলগুলোর অবস্থানগত দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে কিশিদা মন্ত্রিসভা দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে আপাতত সক্ষম হয়েছে। তবে নতুন বছরে তা আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে জাপানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। সে রকম অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হতে পারে। সম্ভাব্য সেই নির্বাচনের ফলাফল কোন দিকে যাবে, তার অনেকটাই নির্ভর করবে জাপানের রাজনীতিতে নতুন কোনো মেরুকরণ ঘটে কি না, তার ওপর।