ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতীক ‘নাপাম গার্ল’ ছবির ৫০ বছর
আমি এখন শুধু ‘নাপাম গার্ল’ নই
সত্তরের দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের ‘নাপাম গার্ল’ ছবিটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। ছবির ‘বিষয়বস্তু’ ছিল নাপাম বোমার ভয়াবহতার শিকার ৯ বছরের মেয়েশিশু কিম ফুক প্যান থি। বর্তমানে তিনি ইউনেসকোর শুভেচ্ছাদূত; যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে শিশুদের সহায়তায় কাজ করছেন। ১৯৭২ সালের ৮ জুন ছবিটি তুলেছিলেন বার্তা সংস্থা এপির তৎকালীন আলোকচিত্রী নিক উত। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রী, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধে ভূমিকা রাখা সেই ছবির ৫০ বছর এমন একসময় পূর্ণ হলো যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। তাইওয়ান ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে চলছে চীনের সামরিক মহড়া। আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে সশস্ত্র সংঘাত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে কিম ফুক প্যান থি নিবন্ধ লিখেছেন নিউইয়র্ক টাইমস–এ। তাঁর নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন হাসান ইমাম।
আমি বেড়ে উঠেছি দক্ষিণ ভিয়েতনামের ছোট গ্রাম—ত্রাং ব্যাংয়ে। আমার মা বলতেন, আর দশটা মেয়ের মতো আমিও খুব হাসিখুশি ছিলাম। আমাদের জীবন ছিল সরল, সাদামাটা। খাবারদাবারের অভাব ছিল না। আমাদের একটা খামার ছিল। এ ছাড়া শহরের সবচেয়ে ভালো রেস্তোরাঁটা চালাতেন আমার মা। মনে আছে, স্কুলের চমৎকার দিনগুলোর কথা। আমার কাজিন ও গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতাম; দড়িলাফ, একে অপরকে দৌড়ে ধরা—কী যে আনন্দের সব খেলা।
এসবই বদলে গেল ১৯৭২ সালের ৮ জুন। সেই ভয়ংকর দিনটির কিছু চকিত স্মৃতি কেবল আমার মধ্যে বেঁচে আছে। মন্দিরপ্রাঙ্গণে কাজিনদের সঙ্গে খেলছিলাম। হঠাৎ একটি বিমান ধাঁ করে নিচে নেমে এল, কানে তালা ধরিয়ে দেওয়ার মতো শব্দে। এরপর বিস্ফোরণ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর দুঃসহ যন্ত্রণা। আমার বয়স তখন মাত্র ৯ বছর।
নাপামের (একধরনের বোমা) থাবা থেকে রেহাই নেই, তা আপনি যত জোরেই ছোটেন না কেন। ভয়ংকরভাবে দগ্ধ করবে আপনাকে এবং সারা জীবন বয়ে বেড়াবেন তার অসহনীয় যন্ত্রণা। আমার ঠিক মনে পড়ে না, দৌড়াতে দৌড়াতে ‘নং কুয়া! নং কুয়া!’ (কী ভয়ংকর জ্বলুনি! কী ভয়ংকর জ্বলুনি!) বলছিলাম কি না। তবে সেই সময়ের ধারণ করা ভিডিওতে জানা যায়, আমি তা–ই বলছিলাম।
আপনি সম্ভবত সেই দিন আমার ছবিটি দেখে থাকবেন; বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে অন্যদের সঙ্গে ছুটছে—কাপড়চোপড় ছাড়া একটি মেয়েশিশু, যার দুহাত প্রসারিত এবং সে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। ছবিটি তুলেছিলেন ভিয়েতনামের ফটোসাংবাদিক নিক উত, তিনি তখন অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) হয়ে কাজ করতেন। ছবিটি বিশ্বব্যাপী পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয় এবং পরে পুলিৎজার পুরস্কার জেতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম বিখ্যাত ছবিতে পরিণত হয় সেটি।
২.
এই স্মরণীয় ছবিটির মাধ্যমে আলোকচিত্রী নিক আমার জীবন স্থায়ীভাবেই বদলে দিলেন। কিন্তু তিনি আমার জীবনও বাঁচিয়েছেন। ছবি তোলার পর তিনি তাঁর ক্যামেরা নামিয়ে রাখেন। আমাকে একটি কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দেন এবং দ্রুত আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এ জন্য তাঁর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।
আবার এ কথাও মনে আছে, একটা সময় পর্যন্ত তাঁকে (নিক) অপছন্দ করতাম। পছন্দ হতো না ছবিটিও। ভাবতাম, ‘আমি একটা ছোট্ট মেয়ে। আমার শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। কেন তিনি সেই সময়ের ছবি তুললেন? কেন আমার মা–বাবা আমায় রক্ষা করলেন না? কেন শুধু আমিই পোশাক ছাড়া ছিলাম? ছবিতে থাকা আমার ভাই ও কাজিনদের সবার গায়ে তো কাপড় ছিল।’ আমার খুবই খারাপ লাগত, লজ্জা বোধ করতাম।
দিন দিন বড় হচ্ছিলাম। সে সময় কখনো কখনো মনে হতো আমি যদি হারিয়ে যেতাম, খুব ভালো হয়! এটা কেবল আমার শরীরের এক–তৃতীয়াংশ পুড়ে গেছে বলে নয়, পোড়ার তীব্র যন্ত্রণা আছে বলে নয়, আমাকে এভাবে উপস্থাপনের জন্য বিব্রত বোধ করা থেকে, লজ্জা থেকে এমনটা চাইতাম। আমার শরীরের ক্ষত কাপড়ে ঢাকতে ঢাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভয়ংকর উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা ঘিরে ধরে আমাকে। স্কুলের বাচ্চারা আমার কাছে ঘেঁষত না। আমি যেন প্রতিবেশীদের কাছে করুণার পাত্র হয়ে উঠেছিলাম এবং কিছুটা মা–বাবার কাছেও। বড় হওয়ার পর মনে হতো, কেউ আমায় কোনো দিন ভালোও বাসবে না।
তত দিনে ছবিটি আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাব পড়ে আমার ব্যক্তিগত জীবনে; নিজের মতো করে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। গত শতকের আশির দশকের শুরু থেকে অসংখ্যবার আমি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছি, সাক্ষাৎকার দিয়েছি। এ জন্য আমি সম্মানী পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী থেকে উচ্চপর্যায়ের অনেক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই আশা করতেন, আমার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি থেকে নতুন কিছু তাঁরা পাবেন। রাস্তায় দৌড়াতে থাকা শিশুর ছবিটি যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতীকে পরিণত হয়। বাস্তবের মানুষটিকেও সেই ভীতি থেকে, সেই ছায়াময়তা থেকে দেখা হতো, যাতে করে আমি একজন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হই।
৩.
সংজ্ঞা অনুযায়ী, সময়ের বিশেষ এক মুহূর্তকে ধারণ করে ছবি। কিন্তু ছবিতে থাকা ব্যক্তিরা, বিশেষ করে শিশুরা অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে সামনে এগিয়ে যায়, ছবির মতো থমকে থাকে না। আমরা প্রতীকী কিছু নই, আমরা মানুষ। আমাদের কাজ করতে হয়। ভালোবাসার মানুষকে পেতে হয়। মেলামেশা করার মতো লোকজন চাই। পড়ালেখার জন্য, বেড়ে ওঠার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ।
কানাডায় পাড়ি জমানোর পর, পরিণত বয়সে আমি প্রথম শান্তির খোঁজ পেতে শুরু করি, জীবনের লক্ষ্য বুঝতে শুরু করি। এ ক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস যেমন কাজ করেছে, তেমনি পেয়েছি স্বামী ও বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য। সবার সহযোগিতায় একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুলি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ শুরু করি। উদ্দেশ্য, যুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার শিশুদের মানসিকভাবে সাহস জোগানো, তাদের ওষুধপত্র দেওয়া এবং তাদের এটা বিশ্বাস করানো যে আশা আছে, সব সম্ভাবনা হারিয়ে যায়নি।
যদি আপনার গ্রামে বোমা ফেলা হয়, যদি আপনি দেখতে পান আপনার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, পরিবারের সদস্যরা মারা গেছে, রাস্তায় পড়ে আছে নিরপরাধ মানুষের মরদেহ, এতে আপনার অনুভূতি কেমন হবে, তা আমি জানি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের এমন ভয়াবহতার সাক্ষ্য বহন করছে অগণিত সংবাদচিত্রে। দুঃখজনক বিষয় হলো, সব যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি আসলে একই রকম; যেভাবে আজ ইউক্রেনে মানুষের অমূল্য জীবন ক্ষয় করা হচ্ছে, সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে, এর সঙ্গেও ভিয়েতনাম যুদ্ধের কোনো ফারাক নেই।
আবার একটু অন্যভাবে দেখলে, এসব ছবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালানো বন্দুক হামলার ভয়ংকর ছবিরও অনুরূপ। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমনটা দেখি, এ ক্ষেত্রে সেভাবে হয়তো আমরা মরদেহ দেখছি না, কিন্তু এসব বন্দুক হামলা অভ্যন্তরীণভাবে যুদ্ধেরই সমার্থক। গণহত্যার ছবি, বিশেষ করে হামলার শিকার শিশুদের ছবি প্রকাশ্যে আনা হয়তো অসম্ভবই ঠেকে, কিন্তু আমাদের অবশ্যই এর মুখোমুখি হতে হবে। আমরা যদি যুদ্ধের পরিণতি দেখতে না পাই, তবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা লুকিয়ে রাখা সহজ হয়ে যায়।
আমি টেক্সাসের ইউভালদের স্কুলে বন্দুক হামলার ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না, কিন্তু আমি মনে করি, বন্দুক হামলার জেরে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, সেই বাস্তবতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা দরকার। আমাদের অবশ্যই এই সহিংসতাকে সামনে থেকে রোধ করতে হবে এবং এর প্রথম পদক্ষেপ হলো এটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া নয়, বরং এর দিকে নজর দেওয়া।
৪.
শরীরে যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। শারীরিক বা মানসিকভাবে আপনি কোনো ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠেননি। ৯ বছর বয়সের আমাকে যেভাবে ছবিতে ধরা হয়েছে, এ জন্য যেমন জীবনের পথে হাঁটতে হয়েছে, ছবির সেই শক্তির জন্য এখন আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি।
আমার জীবনের ভয়াবহতা—যাকে আমি সেভাবে স্মরণে রাখতে চাই না—তা–ই সর্বজনীন হয়ে উঠেছে এ ছবির কারণেই। আমি গর্ব বোধ করি এ কারণে যে একটা সময় আমি শান্তির প্রতীকে পরিণত হয়েছিলাম। আমি যে একজন রক্তমাংসের মানুষ, আমার মধ্যে এমন জীবনবোধ তৈরি হতে অনেক সময় লেগেছে এ জন্য। তবু আজ ৫০ বছর পর, আমি বলতে পারি, ছবিটির জন্য আমাকে যত যা–ই মুশকিলের মধ্যে পড়তে হয়েছে, সেসব সত্ত্বেও নিক (আলোকচিত্রী) সেই মুহূর্ত ধরায় আমি সত্যি আনন্দিত।
যে কাজটি মানবতার, ছবিটি সেটাই করবে—সব সময় আমাদের অকথিত অশুভ দিকটির কথা মনে করিয়ে দেবে। আমি বিশ্বাস করি, শান্তি, ভালোবাসা, আশা ও ক্ষমাশীলতা সব সময়ই যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
নিবন্ধটি নিউইয়র্ক টাইমসে ৬ জুন প্রকাশিত
(সংক্ষেপিত)