‘আগ্রাসী, কালো চিবুকের’ তেলাপিয়া নিয়ে থাইল্যান্ডে হিমশিম

তেলাপিয়া মাছছবি: থাইল্যান্ডের মৎস্য বিভাগ

থাইল্যান্ডে এ পর্যন্ত যত আগ্রাসী প্রজাতির মাছ দেখা গেছে, এটি তার মধ্যে ‘সবচেয়ে আগ্রাসী’। পরিবেশের জন্যও ভীষণ রকমের ঝুঁকি তৈরি করছে মাছের এ প্রজাতি। ‘ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া’ (কালো চিবুকের তেলাপিয়া) নিয়ে এমন বক্তব্য দেশটির কর্মকর্তাদের।

আগ্রাসী এ মাছ নিয়ন্ত্রণে থাইল্যান্ডের হ্রদ ও জলাশয়গুলো চষে বেড়াচ্ছেন লোকজন। পাশাপাশি চেষ্টা চলছে, এর জিনগত রূপান্তরেরও। এরপরও জলাশয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে ‘ব্ল্যাকচিন’ তেলাপিয়া; যার প্রভাব পড়েছে দেশটির ১৭টি প্রদেশে।

পরিস্থিতি এমন যে বিশেষ প্রজাতির এ তেলাপিয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণ উদ্‌ঘাটনে পার্লামেন্টে তদন্ত শুরু হয়েছে। এর নেতৃত্বে থাকা আইনপ্রণেতা নাট্টাচা বুনচাইনসাওয়াত ঘোষণা করেছেন, ‘আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি বিপর্যয়কর প্রতিবেশব্যবস্থা রেখে যেতে পারি না।’

ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া বেড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যার মূলে রয়েছে মাছটির ছোট মাছ, চিংড়ি ও শামুকের লার্ভা খেয়ে ফেলার বিষয়টি। এগুলো থাইল্যান্ডের মূল্যবান জলজ সম্পদ বলে বিবেচিত।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, থাই কর্তৃপক্ষ কি এ লড়াইয়ে জিততে পারবে? আর কীভাবেই বা পশ্চিম আফ্রিকার এ মাছ অর্ধেক বিশ্বে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে?

‘এলিয়েন’ প্রজাতির মাছের বিরুদ্ধে লড়াই

থাইল্যান্ডে আগেও ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের মতো এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা অতীতে দেখা যায়নি।

নাট্টাচা বুনচাইনসাওয়াতের অনুমান, এবার এ প্রজাতির তেলাপিয়া যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে দেশের অর্থনীতি ১০ বিলিয়ন (এক হাজার কোটি) বাথ (থাইল্যান্ডের মুদ্রা) ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া বেড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যার মূলে রয়েছে মাছটির ছোট মাছ, চিংড়ি ও শামুকের লার্ভা খেয়ে ফেলার বিষয়টি। এগুলো থাইল্যান্ডের মূল্যবান জলজ সম্পদ বলে বিবেচিত।

জনগণকে এ ঘটনায় আমাদের ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। অন্যথায় বিষয়টি থমকে যাবে এবং আমরা এমন পরিবেশগত সমস্যাকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে ঠেলে দেব।
নাট্টাচা বুনচাইনসাওয়াত, থাইল্যান্ডের আইনপ্রণেতা

তাই সরকার কয়েক মাস ধরেই লোকজনকে এ প্রজাতির তেলাপিয়া ধরায় উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। এ মাছ ঈষৎ লোনাপানিতে বেড়ে ওঠে। তবে মিঠাপানি ও লোনাপানিতেও বেঁচে থাকতে পারে এরা।

তেলাপিয়া ধরতে শুধু উৎসাহ জোগানোই নয়, লোকজনকে রীতিমতো পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কেউ যদি এ মাছ ধরেন, তবে প্রতি কেজির জন্য ১৫ বাথ পাবেন তিনি। এর ফলাফল কী? রাজধানী ব্যাংককের উপকণ্ঠে পর্যন্ত মানুষ ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া ধরার আশায় প্লাস্টিকের গামলা নিয়ে হাঁটুজলে নেমে পড়ছেন।

ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া শিকারে বিভিন্ন জলাশয়ে ‘এশিয়ান সিবাস’ ও দীর্ঘ গোঁফওয়ালা ‘ক্যাটফিশ’ মাছও ছেড়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা এমন এক প্রজাতির মাছের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে, যেটি দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে।

এ অবস্থায় ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়ার জেনেটিক রূপান্তরের চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। এ প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধিতে অক্ষম তেলাপিয়া উৎপাদন করা হবে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এমন মাছ অবমুক্ত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। কর্তৃপক্ষের আশা, এর মধ্য দিয়ে আগ্রাসী প্রজাতির তেলাপিয়ার বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।

অবশ্য নাট্টাচা বিবিসিকে বলেন, ‘থাই সরকারের আরও কিছু করতে হবে।’ বিবিসি প্রশ্ন করে, ‘এতে কে জিতবে?’ তিনি বলেন, ‘জনগণকে এ ঘটনায় আমাদের ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। অন্যথায় বিষয়টি থমকে যাবে এবং আমরা এমন পরিবেশগত সমস্যাকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে ঠেলে দেব।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগ্রাসী প্রজাতির এই তেলাপিয়া চেনার উপায় খুব সহজ। এর চিবুক ও গালে কালো দাগ রয়েছে।

মাছের খাবার নিয়ে ১৪ বছর আগে চারোয়েন পোকফান্ড ফুড (সিপিএফ) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চালানো পরীক্ষা–নিরীক্ষা থাইল্যান্ডে ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে—এমন একটি তত্ত্ব খতিয়ে দেখছে দেশটির পার্লামেন্ট।

পশুখাদ্য উৎপাদন এবং চিংড়ি ও গবাদিপশুর খামার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের শেষ দিকে ঘানা থেকে বিশেষ ওই মাছের খাবার আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এ খাবার খেয়ে যেসব মাছ মারা গেছে, সেগুলো যথাযথভাবে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে।

থাই সম্প্রচারমাধ্যম পিবিএস বলেছে, ওই ঘটনার দুই বছর পর থাইল্যান্ডে ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়। যেসব স্থানে তেলাপিয়া ছড়িয়ে পড়ে, সেসব স্থানের মধ্যে সিপিএফের গবেষণাগারও ছিল।

তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে সিপিএফ। যাঁরা এমন অভিযোগ ছড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ারও হুমকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সিপিএফ বলেছে, মাছের এ ‘এলিয়েন প্রজাতি’র বিস্তার রোধে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে তারাও কাজ করছে।

থাই মৎস্য বিভাগের মহাপরিচালক বাঞ্চা সুক্কাওয়ে বিবিসিকে বলেন, ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া আমদানির জন্য শুধু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনুমতি চেয়েছিল। থাইল্যান্ডে আগ্রাসী প্রজাতির এ মাছ চোরাই পথেও এসে থাকতে পারে—সে সম্ভাবনাও নাকচ করে দেননি তিনি।

যাহোক এই মাছ থাইল্যান্ডে কীভাবে এসেছে, সেটি এখন অতীত বিষয়। সমস্যা হলো, এ মাছ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যাবে কি না, তা নিয়ে।

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে বলেন, ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়ার বিরুদ্ধে থাইল্যান্ডের যুদ্ধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। তাঁদের একজন থাইল্যান্ডের ওয়ালাইলাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াটিক অ্যানিমেল জেনেটিকসের বিশেষজ্ঞ সুইত উথিসুথিমেথাভি বলেন, ‘আমি এটি (ব্ল্যাকচিন তেলাপিয়া) নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। কেননা আমরা এর প্রজনন রোধ পারব না। প্রাকৃতিকভাবেই এটি ঘটতে থাকবে। এর বংশবৃদ্ধিও ঘটে দ্রুত।’

সুইত উথিসুথিমেথাভির কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেন আরেক বিশেষজ্ঞ নন প্যানিতভং। তিনি বলেন, ‘এলিয়েন প্রজাতির প্রাণিকুল নিয়ে সমস্যা হলো, এগুলো একবার যখন আবাস গড়ে তোলে, তখন এদের নির্মূল করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।’