ঘূর্ণিঝড়ে হাজারো মৃত্যুর শঙ্কা: ‘মনে হচ্ছে এখানে পরমাণু যুদ্ধ হয়েছে’

ঘূর্ণিঝড় চিডোর আঘাতে লন্ডভন্ড হয়েছে ফ্রান্সশাসিত ভারত মহাসাগরের মায়োতে দ্বীপপুঞ্জছবি: এএফপি

আফ্রিকা মহাদেশসংলগ্ন ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে আঘাত হেনেছে ৯০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘চিডো’। এতে তছনছ হয়েছে ফ্রান্সশাসিত মায়োতে দ্বীপপুঞ্জ। সেখানকার টিনের ছাউনির ঘরগুলো বলতে গেলে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

বিনাশী এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন দ্বীপের দরিদ্র বাসিন্দারা। মায়োতে দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী মামোউদজৌউয়ের এক বাসিন্দা বলেন, ‘তিন দিন হলো আমাদের এখানে পানি নেই।’ আরেকজন বলেন, ‘আমার প্রতিবেশীদের কয়েকজন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিয়ে রয়েছেন।’

চিডো আঘাত হানে গত শনিবার। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটারের বেশি। ঘূর্ণিঝড়ের পর জীবিতদের খোঁজে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। ফ্রান্স থেকে উদ্ধারকারীরা এসেও তাঁদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন। এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের আশঙ্কা—এই সংখ্যা কয়েক হাজার হতে পারে।

মায়োতের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই দ্বীপপুঞ্জে বিপুলসংখ্যক অনিবন্ধিত অভিবাসী রয়েছেন। দ্বীপপুঞ্জের ৩ লাখ ২০ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ১ লাখের বেশি এমন অভিবাসী। তাঁদের কারণে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা বের করতে ঝামেলা হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা যে কয়েক হাজার হতে পারে, তা নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছেন মায়োতের প্রিফেন্স (প্রধান কর্মকর্তা) ফ্রাঙ্কোয়িস জেভিয়ারও।

মায়োতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন অনিবন্ধিত অভিবাসীরা। বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁরা আশ্রয়ের খোঁজে ফরাসি দ্বীপটিতে এসেছেন। সেখানে তাঁদের আবাসস্থলগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দ্বীপপুঞ্জের অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুৎ পরিবহনের লাইনগুলো পানিতে ডুবে গেছে, সড়ক দিয়ে চলাচলের অবস্থা নেই। ফলে জরুরি উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। উপদ্রুত মানুষের জন্য জরুরি আশ্রয় তৈরি করতে ত্রিপলসহ নানা সামগ্রী নিয়ে এসেছে একটি উড়োজাহাজ। তবে কিছু এলাকায় খাবার, পানি ও আশ্রয়ের তীব্র সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

মামোউদজৌউয়ের এক বাসিন্দা জন বালোজ। ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ের পর এখনো কীভাবে বেঁচে আছেন—তা তাঁকে হতবাক করেছে। বালোজ বলেন, ‘জীবনের শেষ সময়টা আমার দিকে ধেয়ে আসছিল। তা দেখে আমি চিৎকার করছিলাম। সবকিছুর ক্ষতি হয়েছে, পানি পরিশোধনকেন্দ্র, বিদ্যুতের পিলার—প্রায় সবকিছু। (সব গুছিয়ে নিতে) এখন অনেক কিছু করতে হবে।’

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উদ্ধারকাজ চলছে
ছবি: রয়টার্স

ঘূর্ণিঝড়ের পর মায়োতের অবস্থা মর্মান্তিক বলে উল্লেখ করেছেন রাজধানীর আরেক বাসিন্দা মোহামেদ ইসমায়েল। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমি পুরো এলাকা ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছি। আপনার মনে হবে পরমাণু যুদ্ধ–পরবর্তী কোনো পরিস্থিতিতে রয়েছেন।’

মায়োতের সিনেটর সালামা রামিয়া ফরাসি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাকে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ক্ষুধার বিষয়টি। অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁদের কাছে গত শনিবার থেকে খাওয়া বা পান করার কিছুই নেই।’

মায়োতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন অনিবন্ধিত অভিবাসীরা। বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁরা আশ্রয়ের খোঁজে ফরাসি দ্বীপটিতে এসেছেন। সেখানে তাঁদের আবাসস্থলগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মায়োতে দ্বীপপুঞ্জে মৃত্যুর সংখ্যা যে অনেক বাড়তে পারে, সে শঙ্কা করছেন ফরাসি রেড ক্রসের মুখপাত্র এরিক স্যাম ভাহও। বিবিসিকে তিনি বলেন, দ্বীপপুঞ্জের বস্তি এলাকাগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখনো বাস্তুচ্যুত মানুষের বিষয়ে কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তাই আগামী দিনগুলোতে বাস্তবতাটা ভয়াবহ হতে পারে।

১৮৪১ সালে মায়োতে দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল ফ্রান্স। বিশ শতক নাগাদ তারা আরও তিনটি দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের আওতায় নেয়। এই দ্বীপপুঞ্জগুলো নিয়ে করোমোস দ্বীপপুঞ্জ গঠিত। ১৯৭৪ সালে ফরাসি শাসন থেকে স্বাধীন হয় কমোরোস। তবে ফ্রান্সের অংশ হিসেবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মায়োতে।

মায়োতের বাসিন্দারা ফরাসি সহায়তার ওপর বড় আকারে নির্ভরশীল। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো সংকটের সঙ্গে লড়াই করছেন। পরিসংখ্যান বলছে, মায়োতের ৭৫ শতাংশ বাসিন্দা জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। আর দ্বীপপুঞ্জটির প্রতি তিনজন বাসিন্দার একজন বেকার।

ঘূর্ণিঝড় চিডোর আঘাতে ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ
ছবি: এএফপি

এদিকে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকেও আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় চিডো। এতে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় পেমবা শহরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে হঠাৎ করে বন্যা দেখা দিয়েছে, উপড়ে গেছে গাছপালা, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাড়িঘর। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে শনিবার সকালে মোজাম্বিকের উত্তর উপকূলে নামপুলা ও কাবো দেলগাদো প্রদেশে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। সেখানে বিদ্যুৎও নেই।

ঘূণিঝড় চিডোর ভয়াবহতার জন্য অনেকেই দায়ী করছেন জলবায়ু পরিবর্তনকে। ফ্রান্সের আবহাওয়া বিভাগের আবহাওয়াবিদ ফ্রাঙ্কোইস গোউরান্ড বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরের উষ্ণ পানির জন্য ‘ব্যতিক্রমী’ এই ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।

আরও পড়ুন