ফিরে দেখা
নিজেকে বাঁচাতেও কখনো মাথা নত করেননি ম্যান্ডেলা
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার প্রয়াণদিবস আজ ৫ ডিসেম্বর। তাঁর স্মরণে আজ পাঠকদের জন্য এ আয়োজন।
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৫ ডিসেম্বর। তাঁর জীবন ও কর্ম দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের পাশাপাশি পুরো বিশ্বের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বিশ্বকে পুরোপুরি বদলে দিতে ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন, সেটা তাঁর জীবদ্দশায়ে এমনকি মৃত্যুর পর নানাভাবে ফুটে উঠেছে।
একক উদ্যোগ
নেলসন ম্যান্ডেলা প্রথম থেকে জানতেন, পরিবর্তনের অনুঘটক হতে পারেন একজনমাত্র ব্যক্তি। তিনি একক ব্যক্তি হিসেবে এই অনুঘটক হতে ভয় পাননি। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার এম্ভেজে গ্রামে। সেখান থেকে বেড়ে উঠে তিনি একটি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসংখ্য মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। এসব করেছেন তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে। ম্যান্ডেলা তাঁর জীবদ্দশায় অনেক সংগঠন ও জোট গঠন করেন এবং বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দেন।
একজন ব্যক্তি যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন, তার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তিনি ব্যক্তিগত ও পেশাদারি জীবনে এমন কঠিন পথে হেঁটেছেন, যা সচরাচর সবাই পারেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইনি প্রতিষ্ঠান তৈরি, আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেস ইয়ুথ লিগ গঠন, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মতো পদক্ষেপগুলো ছিল তাঁর স্বাধীনতার যাত্রাপথে হাঁটার শক্তিশালী উদাহরণ।
আদর্শে অবিচল
ইতিহাসে নেলসন ম্যান্ডেলার চেয়ে খুব কম শক্তিশালী চরিত্র দেখা যায়, যিনি মর্যাদাপূর্ণ ধূসর স্যুটে বজ্রমুষ্টি নিয়ে হাজির হতে পেরেছিলেন। ২৭ বছর কারাভোগের পর তিনি প্রেসিডেন্ট হন। এর আগে মাত্র ৪৪ বছরে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বের জন্য বর্ণবাদী সরকার তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। বর্ণবাদবিরোধী কর্ম ও অবস্থানের জন্য সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল তাঁর দল।
আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা হিসেবে তাঁর কাজের জন্য ১৯৬২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর আগেও তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ম্যান্ডেলা তাঁর শৈশবের শিক্ষা ও মূল্যবোধগুলো বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। ম্যান্ডেলা তাঁর বিশ্বাসকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন এবং তা দিয়েই চারপাশ আলোকিত করেছিলেন।
ত্যাগের উদাহরণ
নিজের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ মেনে নেননি ম্যান্ডেলা। আত্মপক্ষ সমর্থন করতেও অস্বীকার করেন তিনি। ১৯৮৫ সালে সরকার ম্যান্ডেলাকে এই শর্তে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেয় যে তিনি মুক্ত হলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন না। কিন্তু ম্যান্ডেলা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘এমন সময়ে কোনো অঙ্গীকার করতে পারি না বা করবও না, যখন আমি এবং আপনি, জনগণ, স্বাধীন নই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের স্বাধীনতা ও আমার স্বাধীনতাকে পৃথক করার কোনো সুযোগ নেই।’
ন্যায্য বিচারের বার্তা
ম্যান্ডেলা জানতেন, তাঁর সংগ্রাম জনগণের জন্য। জনগণের সংগ্রামকে নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি। সেই সংগ্রাম এবং তার ন্যায়বিচারের বার্তা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ব ধীরে ধীরে বর্ণবাদী শাসনের অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকানদের দুর্দশা সম্পর্কে বুঝতে পারে। এর পেছনে ছিল ম্যান্ডেলার জোরালো বার্তা।
কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের স্বাধীনতার জন্য ম্যান্ডেলার সংগ্রামের বিষয়টি মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছিল। তাঁর বার্তা এতটাই শক্তিশালী ছিলে যে তাঁর নামে বিক্ষোভের একটি গান হয়ে দাঁড়ায় ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা’। ম্যান্ডেলার বার্তা ছিল শান্তি, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার, যা সব মানুষ সমর্থন করতে পারে। ভবিষ্যৎ নেতা–কর্মীদের জন্য বার্তা ও সমাবেশ করার নজিরও স্থাপন করেন তিনি।
গড়ে তুলেছেন সংস্থা
ম্যান্ডেলা সংস্থা তৈরিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ন্যায়বিচার ও শান্তির জন্য তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন। ম্যান্ডেলা যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছিলেন—যেমন বিচার, আলোচনা, সামাজিক সংহতি—সেগুলোই নিয়ে এ সংস্থাটি কাজ করে।
এইচআইভির বিরুদ্ধে লড়াই
ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এইচআইভি বা এইডসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যুগান্তকারী এক বক্তৃতা দিয়েছেন। ২০০০ সালের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে। তখন ম্যান্ডেলা দ্রুত এআইচআইভি প্রতিরোধে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এ নিয়ে খুব বেশি কাজ না করার আফসোস ছিল তাঁর। তবে তিনি একাই ভবিষ্যতে এআইচভি ছড়ানো ঠেকাতে নতুন এজেন্ডা ঠিক করেন। ২০০০ সালে ডারবানে আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এ ছাড়া মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি এ নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করে গেছেন।
অতীত থেকে শিক্ষা
ম্যান্ডেলা বুঝতে পেরেছিলেন, ক্ষমা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইতিহাস কখনোই তাঁর অস্থির অতীত ভুলে যাবে না। নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদ শাসনের অধীনে অন্যায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধের পরিবর্তে স্মরণ করে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একটি জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার মূল চাবিকাঠি হলো অস্থির অতীত থেকে বোঝা ও শিক্ষা নেওয়া।
এসব বিষয় মাথায় রেখে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যান্ডেলার প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ নামে একটি কমিটি গঠন করা। এটি ছিল সরকারি একটি সংস্থা, যার কাজ ছিল ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বর্ণবাদী সরকারের আমলের সংঘটিত অপরাধগুলোর তদন্ত করা। তাঁর এ উদ্যোগকে মানবাধিকার তদন্তকারীদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা হয়। অতীতের নৃশংসতা থেকে নিরাময় এবং বিভক্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ এটি।
তথ্যসূত্র: এনবিসি নিউজ, রেড ওআরজি ও এএফপি অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন