টিকায় পরনির্ভরতা কাটাতে চায় আফ্রিকা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা বিভিন্ন। ইউরোপের এক দেশে যখন সংক্রমণ কমছে, তখন হয়তো এশিয়ার আরেক দেশে বাড়ছে। আবার আফ্রিকার কোনো দেশে সংক্রমণ যখন তুঙ্গে, তখন হয়তো লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে।
গত মে মাসের শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আফ্রিকায় করোনার সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা করেছে। টিকা সরবরাহে দীর্ঘসূত্রতা, টিকাদান কর্মসূচিতে ধীরগতি এবং করোনার নতুন ধরনের কারণে আফ্রিকায় করোনা বাড়তে পারে। একই রকম আশঙ্কা করছেন আফ্রিকা সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের পরিচালক জন নাকেনগাসং। আর এ ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন ভারতের করোনা পরিস্থিতিকে। প্রথম দফা সংক্রমণের ধাক্কা কিছুটা সামলে উঠতে না উঠতেই করোনাভাইরাস ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে। নাকেনগাসং বলছেন, করোনার কারণে ভারতে এত বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়েছে যে ভারত শুধু নিজেদের দেশের জনগণের জন্যই টিকা বরাদ্দ রেখেছে। বাইরের দেশে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের পরিস্থিতি অন্য অঞ্চলের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে জানা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আফ্রিকার কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনার টিকার ডোজ পেতে দেরি হয়েছে আফ্রিকার। আর এর ফলে এ অঞ্চলে টিকাদানও কম হয়েছে। আর এখন টিকা রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় আফ্রিকার বিপদ আরও বেড়েছে।’
টিকা নিয়ে বৈশ্বিক কোভ্যাক্স উদ্যোগের আওতায় আফ্রিকার ৪১টি দেশ চলতি বছরের মার্চে টিকা পেতে শুরু করে। এর মধ্যে ৯টি দেশ প্রাপ্ত টিকার মাত্র এক-চতুর্থাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে। এএফপির এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ডব্লিউএইচও বলছে, সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত যত টিকা দেওয়া হয়েছে, তার মাত্র ১ শতাংশ দেওয়া হয়েছে আফ্রিকায়।
তবে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদন বলছে আশার কথা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, টিকাদান নিয়ে এত দিন উদাসীন থাকলেও নড়েচড়ে বসেছে আফ্রিকার দেশগুলো। অনেক দেশই টিকা উৎপাদন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।
আফ্রিকায় ব্যবহৃত টিকার ৯৯ শতাংশ আমদানি করা হয়। আফ্রিকায় টিকা বানানোর জন্য প্রণোদনাও খুব সামান্য। এর মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম দক্ষিণ আফ্রিকা। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার আসপেন ফার্মাকেয়ার জনসন অ্যান্ড জনসনের করোনার টিকা বানাতে সম্মত হয়েছে। এই ওষুধ কোম্পানি বছরে ৩০ কোটি ডোজ টিকা বানায়। দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে টিকার পেটেন্টে ছাড় দিতে চাপ দিচ্ছে।
আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে টিকা বানানোর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রয়টার্সের খবর বলছে, বেলজিয়ান বায়োটেক গ্রুপ ইউনিভার্সেলসের সঙ্গে চুক্তির আওতায় আগামী বছরের মাঝামাঝিতে সেনেগাল ৩০ কোটি ডোজ টিকা তৈরি করবে। ওই প্রকল্পের তহবিল বরাদ্দকারী একটি সূত্র রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছে।
আফ্রিকা সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের পরিচালক জন নাকেনগাসং বলছেন,ভারতের পরিস্থিতি অন্য অঞ্চলের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
ইকোনমিস্ট বলছে, আফ্রিকার আরেক দেশ আলজেরিয়া আগামী সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার স্পুতনিক টিকা বানানো শুরু করতে সম্মত হয়েছে। রুয়ান্ডা এমআরএনএ টিকা বানাতে আগ্রহী। দেশটির প্রেসিডেন্ট পল কাগামে এমআরএনএ টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। নতুন টিকা বানালে দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্যিক সুবিধা পেতে পারে দেশটি। মিসর, তিউনিসিয়া, মরক্কো, ঘানা, কেনিয়াতেও টিকা বানানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে ইয়েলো ফিভার, টিটেনাস, কলেরার টিকা বানানো হয়েছে এসব দেশে। নাইজেরিয়া এবং ইথিওপিয়াতেও টিকা বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
২০০৬ সালে প্রযুক্তি স্থানান্তর কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ফ্লুর টিকার উৎপাদন বাড়ায়। এসব দেশের সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতার কারণে এমন সফলতা এসেছে।
আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট সলোমন কোয়েনর বলেছেন, ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে টিকা সরবরাহের জন্য নতুন প্রকল্প ও চুক্তির প্রয়োজন। টিকা খাতে বিনিয়োগকারীরা সুশাসন, স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি তহবিল ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ওপর জোর দেন। এ জন্য আফ্রিকার দেশগুলোতে এর উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
তবে টিকা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সংকট হলো মহামারি না থাকলে টিকা প্রস্তুতকারকেরা কী করবেন? এ ক্ষেত্রে প্রতিবছর শিশুদের বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে টিকা বানানো সমাধান হতে পারে। বিশ্বের অন্যতম বড় টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হলো ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। সেরাম ভারতের বাইরেও টিকা বানানোর পরিকল্পনা করেছে। তবে সেরাম বলেনি তারা কোথায় টিকা বানাবে।
টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মডার্না আফ্রিকায় টিকা প্রস্তুত করতে চায়। করোনা ছাড়াও মডার্না ইয়েলো ফিভার, চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাসের টিকা বানাতে আগ্রহী।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আফ্রিকার কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া এই উপমহাদেশে টিকার একক বড় বাজার তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে টিকা নিয়ন্ত্রণ ও অনুমোদনের জন্য আফ্রিকান মেডিসিনস এজেন্সি (এমা) কার্যকর করা প্রয়োজন। দুই বছর আগে এমা প্রতিষ্ঠার জন্য খসড়া চুক্তি হয়। তবে এটি কার্যকর করতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক দেশ অনুমোদন দেয়নি। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট সলোমন কোয়েনর বলেন, যদি আফ্রিকার দেশগুলো টিকা তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবে, তাহলে এমাকে অনুমোদন দিতে হবে। আর তা পেলে আফ্রিকা নিজেরাই আরও বেশি টিকা বানাতে পারবে।