রেলপথ তৈরিতে সমতল ভূমিই সেরা। কিন্তু পৃথিবী তো আর শুধু সমতল নয়, বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির এ পৃথিবীতে আছে পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র। রেল চলাচলের ইতিহাসের শুরু থেকে যখনই প্রয়োজন পড়েছে নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে রেলপথ নিজের চলার পথ খুঁজে নিয়েছে। আগে পাহাড় বেয়ে রেলপথ এগিয়ে যেত। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এখন পাহাড় ফুঁড়ে, নদী-সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গপথে এগিয়ে যাচ্ছে রেলপথ। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সুড়ঙ্গ রেলপথের দৈর্ঘ্য এখন ৫০ কিলোমিটারের বেশি। এর চেয়েও বেশি দৈর্ঘ্যের রেলসুড়ঙ্গ তৈরির কাজ চলছে। আগামী এক দশকের মধ্যেই ওই সব সুড়ঙ্গের কাজ শেষ হবে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ ১০ রেলসুড়ঙ্গ নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।
সুইস আল্পসের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া গথার্ড বেজ টানেল বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসুড়ঙ্গ। এটির দৈর্ঘ্য ৫৭ দশমিক শূন্য ৯ কিলোমিটার। ২০১৬ সালে ট্রেন চলাচলের জন্য সুড়ঙ্গটি খুলে দেওয়া হয়। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে সুইজারল্যান্ডের সর্বদক্ষিণের প্রশাসনিক এলাকা টিকিনো থেকে বাকি দেশ এবং উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের যোগাযোগ দ্রুততর হয়েছে।
এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ও গভীর রেলসুড়ঙ্গ জাপানের সেইকান টানেল। দৈর্ঘ্য ৫৩ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। এটির একটি অংশ জাপানের সুগারু প্রণালির নিচ দিয়ে গেছে; সংযুক্ত করেছে হোক্কাইডো ও হনসু দ্বীপকে। সুড়ঙ্গপথটির যে অংশ (২৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার) সমুদ্রের নিচ দিয়ে গেছে, সেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০ মিটার ও সমুদ্র তলদেশ থেকে ১০০ মিটার নিচে অবস্থিত। ১৯৮৮ সালে রেলসুড়ঙ্গটি খুলে দেওয়া হয়। জাপানের উচ্চগতির ও সাধারণ ট্রেন উভয়ই এ সুড়ঙ্গপথ দিয়ে চলাচল করে। ‘চ্যানেল টানেল’–এর পর এটিই হলো বিশ্বে সমুদ্রতলের দ্বিতীয় বৃহত্তম সুড়ঙ্গ।
ইংলিশ চ্যানেলের নিচে তৈরি করা হয়েছে ৫০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল টানেল। এ রেলসুড়ঙ্গ ইউরোপের দুই দেশ ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যকে সংযুক্ত করেছে। এটি সমুদ্রের নিচে তৈরি করা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সুড়ঙ্গ রেলপথ। ছয় বছর নির্মাণকাজের পর ১৯৯৪ সালে সুড়ঙ্গ রেলপথটি ট্রেন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। টুইন টিউবের এ রেলসুড়ঙ্গে একটি করে রেলপথ আছে। একটি দিয়ে ট্রেন আসে, অন্যটি দিয়ে যায়। এ ছাড়া একটি সার্ভিস টানেল আছে, যেটি থেকে প্রধান দুই রেলপথে যাওয়া যায়। ৩৭৫ মিটার পরপর যাত্রীরা সার্ভিস টানেল দিয়ে প্রধান দুই টানেলে গিয়ে ট্রেন পরিবর্তনের সুযোগ পান। আড়াআড়ি দুটি সংযোগপথও আছে। ওই দুই সংযোগ দিয়ে ট্রেন এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যেতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়োনগি প্রদেশে অবস্থিত ইয়ুলহিয়ন টানেল ৫০ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা। পাঁচ বছর নির্মাণকাজ শেষে ২০১৬ সালে এ রেলসুড়ঙ্গ খুলে দেওয়া হয়। সুড়ঙ্গটিতে দুটি রেলপথ আছে। এ পথে সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারে।
এ রেলসুড়ঙ্গ চীনের দক্ষিণাঞ্চলের ডংগুয়ান-হুইজোউ ইন্টারসিটি রেলওয়ের জিয়াও স্টেশন ও চ্যাংপিং ইস্ট স্টেশনের মাঝে অবস্থিত। দেশটির মূল ভূখণ্ডের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসুড়ঙ্গটি লম্বায় ৩৮ দশমিক ৮২ কিলোমিটার। সুড়ঙ্গটির ভেতর একটি ট্রেন সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। প্রতিদিন ৩১ জোড়া ট্রেন এ রেলসুড়ঙ্গ পারাপার করে। টুইন টিউবের রেলসুড়ঙ্গটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে, শেষ হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে সুড়ঙ্গটি দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
সুইজারল্যান্ডে আল্পসের ভেতর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এই সুড়ঙ্গ রেলপথ। এটির দৈর্ঘ্য ৩৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার। এটি দিয়ে যাত্রী ও মালবাহী উভয় ট্রেনই চলে। রেলসুড়ঙ্গটি দেশটির দুটি শহরকে সংযুক্ত করেছে। লচবার্গ বেজ টানেল দিয়ে রেল চলাচল শুরু হয় ২০০৭ সালে।
নিউ গুয়ানজিয়াও টানেলটি গুয়ান কক টানেল নামেও পরিচিত। এটি ৩২ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার লম্বা। চীনের উত্তর–পশ্চিমের গুয়ানজিয়াও পর্বতের ভেতর দিয়ে তৈরি চিংহাই-তিব্বত রেলওয়ের দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ রেলপথ এটি। মালভূমিতে তৈরি রেলসুড়ঙ্গের মধ্যে এটি বিশ্বে দীর্ঘতম। দুই টিউবের এ সুড়ঙ্গে দুটি রেলপথ সমান্তরাল চলে গেছে। রেলপথ দুটি দিয়ে সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারে।
রেলসুড়ঙ্গটি জটিল ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৩০০ মিটার উঁচুতে নির্মিত। সুড়ঙ্গটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে, খুলে দেওয়া হয় ২০১৪ সালে। এই রেলসুড়ঙ্গ তৈরির পর গুয়ানকোউ পর্বতমালায় ভ্রমণের সময় ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট কমে গেছে।
স্পেনের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসুড়ঙ্গ গুয়াদারামা টানেল। ২৮ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলসুড়ঙ্গ সিরা দে গুয়াদারামা পর্বতমালার ভেতর দিয়ে গেছে। পাশাপাশি ৩০ মিটার দূরত্বে দুটি সমান্তরাল সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেন চলে। পর্বতমালার ভেতরে রেলসুড়ঙ্গটি সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ মিটার উঁচু দিয়ে গেছে। পাঁচ বছর নির্মাণকাজ শেষে ২০০৭ সালে এটি খুলে দেওয়া হয়।
ওয়েস্ট কিনলিং রেলসুড়ঙ্গটি উত্তর–পশ্চিম চীনের কিন পর্বতমালার ভেতর দিয়ে গেছে। এই রেলসুড়ঙ্গ লানজোউ-চংচিং রেলওয়ের অংশ। কিন পর্বতমালার ভেতর দিয়ে যে কয়টি রেলসুড়ঙ্গ গেছে, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে দীর্ঘ। ২৮ দশমিক ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলসুড়ঙ্গের একটি দিয়ে ট্রেন আসে, আরেকটি দিয়ে যায়। সুড়ঙ্গটি নির্মাণে পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছে। এটি ২০১৬ সালে খুলে দেওয়া হয়।
এই রেলসুড়ঙ্গ উত্তর-মধ্য চীনের তাইহাং পর্বতমালার ভেতর দিয়ে গেছে। এটির দৈর্ঘ্য ২৭ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। টুইন টিউবের এ রেলসুড়ঙ্গের নির্মাণকাজ দুই বছরে শেষ করে ২০০৭ সালে খুলে দেওয়া হয়। ৩৫ মিটার ব্যবধানে তৈরি দুটি টিউবের বাঁ দিকের রেলপথ ২৭ হাজার ৮৩৯ মিটার লম্বা ও ডান দিকের রেলপথটি ২৭ হাজার ৮৪৮ মিটার লম্বা।