ফিরে দেখা
ঢালাইকার থেকে প্রথম মানুষ হিসেবে যেভাবে মহাকাশে পা রাখলেন গ্যাগারিন
বিশ্বের প্রথম মানব হিসেবে মহাকাশে যান সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল তিনি মহাকাশ জয় করেন। পৃথিবীর কক্ষপথে একবার ভ্রমণের মাধ্যমে মানবজাতির মহাকাশযাত্রার যুগের সূচনা করেন তিনি। এটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন। ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশে যাত্রা উপলক্ষে আজকের এ ফিরে দেখা।
দিনটি ছিল ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। কাজাখস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত মহাকাশ বন্দর বাইকোনুর কসমোড্রমে শীতের চাদর ভেদ করে ভোরের আলো ফুটতেই শুরু হয়েছে প্রকৌশলীদের দৌড়ঝাঁপ। প্রতিটি যন্ত্র, প্রতিটি সংযোগ—দ্বিগুণ সতর্কতায় পরীক্ষা চলছে। লঞ্চপ্যাডে (যে স্থান থেকে রকেট উৎক্ষেপণ হয়) তখন উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। এর মধ্যে সেখানে অপেক্ষমাণ ভস্তক–১ রকেটের ককপিটে গিয়ে বসলেন এক তরুণ। গায়ে চাপানো কমলা রঙের স্পেস স্যুট আর চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক।
সেই ঐতিহাসিক সকালে ২৭ বছর বয়সী ওই তরুণকে নিয়ে ছোট্ট মহাকাশ যানটি ছুটে গেল অসীম অজানার উদ্দেশ্যে। সামনে সীমাহীন অনিশ্চয়তা। আর কখনো চেনা ডেরায় ফিরতে পারবেন কি না, জানা নেই। যে গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে চলেছেন সেখানে পৌঁছাতে পারবেন কি না, তার ঠিক নেই। যাত্রাপথে উনিশ-বিশ হলে নেই বেঁচে ফেরার একরত্তি সম্ভাবনা। এরপরও এক অদম্য নেশায় পাড়ি দিলেন পৃথিবী নামক গ্রহের চৌহদ্দি। আর ফিরলেন ইতিহাসের খোলনলচে বদলে দিয়ে। মহাকাশে যাওয়া প্রথম ব্যক্তি হিসেবে পা রাখলেন পৃথিবীর বুকে।
ইউরি গাগারিনের ছেলেবেলা কেটেছে সোভিয়েত রাশিয়ার স্মোলেনস্কক অঞ্চলের ক্লুশিনো গ্রামে, জন্মও সেখানেই। বাবা-মা দুজনই ছিলেন কৃষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁদের পরিবার নাৎসিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধের প্রভাব সংসারে এসে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব সংসারের হাল ধরার তাড়না অনুভত করেন তিনি। ১৯৪৯ সালে বয়স যখন ১৫, ঠিক করলেন মাধ্যমিক স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে নেমে পড়বেন।
বলছি বিখ্যাত সোভিয়েত মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনের কথা। কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া গ্যাগারিন কৈশোরে ছিলেন ঢালাইকার। আকাশে ওড়ার অদম্য নেশা তাঁকে ঢালাই কারখানা থেকে নিয়ে গেছে উড়োজাহাজের ককপিট পর্যন্ত। সময়ের আবর্তে সেই স্বপ্ন আকাশ ছাড়িয়ে ছুঁয়েছে মহাকাশের গণ্ডি। ইউরি গ্যাগারিনের দুঃসাহসী অভিযান খুলে দিয়েছে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে অপার সম্ভাবনার দুয়ার।
প্রথম মানব হিসেবে এই তরুণের মহাকাশে পা রাখার ঘটনা সে সময় বিশ্বের বুকে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বদরবারে রাতারাতি তারকা বনে যান ইউরি গ্যাগারিন। তাঁকে দেওয়া হয় জাতীয় বীরের খেতাব। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর-বাহির থেকে তাঁর ঝুলিতে যোগ হতে থাকে একের পর এক পুরস্কার-সম্মাননা।
সংসারের হাল ধরতে ঢালাইকারের চাকরি
ইউরি গ্যাগারিনের ছেলেবেলা কেটেছে সোভিয়েত রাশিয়ার স্মোলেনস্কক অঞ্চলের ক্লুশিনো গ্রামে, জন্মও সেখানেই। বাবা-মা দুজনই ছিলেন কৃষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁদের পরিবার নাৎসিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধের প্রভাব সংসারে এসে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব সংসারের হাল ধরার তাড়না অনুভব করেন তিনি।
১৯৪৯ সালে বয়স যখন ১৫, ঠিক করলেন মাধ্যমিক স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে নেমে পড়বেন। বাবা-মা ছাড়তে না চাইলেও সিদ্ধান্তে অনড়, চলে গেলেন মস্কোয় চাচার কাছে। তাঁর পরামর্শে মস্কোর উপকণ্ঠে ল্যুবের্তস্কি শহরের কৃষিযন্ত্র বৃত্তি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। তরুণ শ্রমিকদের সন্ধ্যাকালীন বিদ্যালয়ে তার ভবিষ্যৎ পেশা নির্ধারিত হলো ঢালাই কলঘরের ঢালাইকার।
—‘পৃথিবী দেখছি’ শিরোনামে নিজের লেখা বইয়ে ইউরি গ্যাগারিন বলেছেন, ‘পেশাটা সহজ নয়। তাতে শুধু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নয়, রীতিমতো দৈহিক শক্তিও দরকার।’
আকাশে ওড়ার নেশা
ইউরি গ্যাগারিন কৃষিযন্ত্র বৃত্তি বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে চলে গেলেন ভলগা নদীর তীরের সারাতভ শহরের শিল্প টেকনিক্যাল কলেজে পড়তে। সেখানেও পড়াশোনার বিষয় ঢালাইবিদ্যা। যার সঙ্গে মহাকাশ তো দূরের কথা, উড়োজাহাজের সম্পর্কও নেই একচুল। তারপরও সেখানেই পেয়ে বসল আকাশে ওড়ার নেশা।
এ প্রসঙ্গে ইউরি নিজের বইয়ে লিখেছেন, ‘সারাতভেই আমার সেই ব্যাধিটা পেয়ে বসল। চিকিৎসাশাস্ত্রে যার নাম নেই—আকাশের এক অধীর আকর্ষণ, ওড়ার ঝোঁক।’
তবে আকাশে ওড়ার যে ঝোঁক, ইউরির মনে তার বীজ বুনেছিল শৈশোবের এক ঘটনা।
‘পৃথিবী দেখছি’ বইয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের উল্লেখ করে ইউরি লিখেছেন, ‘একবার স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম দুটি সোভিয়েত বিমান নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমাদের ছেলেদের মধ্যে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল: আরে দ্যাখ দ্যাখ, বিমানটা ঘায়েল হয়নি তো?
‘সত্যিই, ছোট্ট জঙ্গি বিমান একবার এ ডানায়, আরেকবার ও ডানায় টলে টলে পড়ছে আর কেবলই নিচে নামছে। অন্য বিমানটা তার ওপরে বড় বড় চক্করে পাক দিচ্ছে, যেন একটা আহত পাখির দেখাশোনা করছে আরেকটা পাখি। বিমানটার পতন ঠেকানোর জন্য নিশ্চয় অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল বৈমানিককে। শেষ পর্যন্ত গাঁয়ের প্রান্তে একটা জলায় নামল বিমানটা। নামতে গিয়ে বিমানটি ভেঙে গেল, তবে কেবিন থেকে লাফিয়ে বের হয়ে পড়তে পেরেছিলেন বৈমানিক।
‘অন্যটাও নামছে! ছুটলাম আমরা জলাটার কাছে। সত্যিই, প্রথমটার পাশেই দ্বিতীয় বিমানটাও নামল একটা মাঠের ওপর। রাত তারা কাটাল কুশিনো গ্রামে, সকালে দুজনেই উড়ে গেল অক্ষত বিমানটায়।
‘পরে ফ্রন্টে যারা লড়ে এসেছে তাদের কাছে, বিমান ক্লাবের শিক্ষকদের কাছে, আমি যে বিমানবাহিনীতে ছিলাম তার কমান্ডারদের কাছে অনেকবারই আমি এই প্রবাদটা শুনেছি: দিতে হয় দেবে জান, বাঁচাবে সাথির প্রাণ। তার মানেটা কী, সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম। দুই বৈমানিকের ওই ঘটনাটা, তাদের পৌরুষের কথা আমি কখনো ভুলব না।’
‘ঢালাইকারের মধ্যে জন্ম নিল বৈমানিক’
টেকনিক্যাল কলেজে থাকতে পদার্থবিদ্যায় ব্যাপক ঝোঁক ছিল ইউরি গ্যাগারিনের। এ বিষয়ে পড়াশোনাও করেছেন ঢের। কলেজের পদার্থবিদ্যার চক্রে দুটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে একটি ছিল রুশ বিজ্ঞানী সিওলকোভস্কির রকেট ইঞ্জিন ও আন্তগ্রহ ভ্রমণের মতবাদ নিয়ে।
সিওলকোভস্কি ছিলেন আধুনিক রকেটবিজ্ঞান ও মহাকাশ অভিযানের অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁকে অনেকে আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞানের জনকও বলে থাকেন। তাঁর মহাকাশবিজ্ঞানের মতবাদ নিয়ে রিপোর্ট লিখতে গিয়ে মহাকাশের নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে পড়তে হয়েছিল ইউরি গ্যাগারিনকে।
সিওলকোভস্কির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘মানবজাতি চিরকাল পৃথিবীতে বাঁধা থাকবে না, আলোক ও মহাকাশের অন্বেষণে সে প্রথমে বায়ুমণ্ডলের সীমা ছাড়িয়ে সন্তর্পণে এগোবে, তারপর জয় করে নেবে সৌরমণ্ডলীর মহাকাশ।’
এ ভবিষ্যদ্বাণী চোখের সামনেই বাস্তবে রূপ নিতে দেখছিলেন ইউরি। তিনি লিখেছেন, ‘সিওলকোভস্কির রচনা নিয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর থেকেই আমার মহাজাগতিক জীবনের শুরু। ঢালাইকারের মধ্যে জন্ম নিল বৈমানিক।’
টেকনিক্যাল কলেজে থাকতেই ইউরি যোগ দেন বিমান ক্লাবে। বিমান ওড়ানোর হাতেখড়ি সেখানেই। এরপর ১৯৫৫ সালে তিনি ভর্তি হন ওরেনবুর্গের বিমান বিদ্যালয়ে। সেখানেই ভ্যালেন্তিনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। ভ্যালেন্তিনা ওরেনবুর্গ মেডিকেল স্কুলের স্নাতক ছিলেন। ওরেনবুর্গে ইউরির জীবন দুটি শুভ ঘটনা ঘটল একসঙ্গে। স্নাতক শেষ করে সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দিলেন এবং ভ্যালেন্তিনাকে বউ করে ঘরে তুললেন।
সবকিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল, ঠিক তখনই হোঁচট খেলেন। বাড়ি থেকে খুব খারাপ একটি চিঠি এল: বাবা অসুস্থ, মা খুব কষ্টে আছেন। মন ছটফট করে উঠল। সব ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা মাথায় উঁকি দিয়েছিল তখন। ভেবেছিলেন বাড়ি গিয়ে কারখানায় কাজ নেবেন। তবে শেষমেশ বউ ও বন্ধুদের উৎসাহে স্বপ্নভ্রষ্ট হতে হতে ফিরে এসেছিলেন তিনি।
জন্মদিনের উপহার মহাকাশের টিকিট
ইউরি যখন ওরেনবুর্গ বিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশ অভিযানে প্রথম সাফল্যের মুখ দেখেছিল। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর মহাকাশে পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুতনিক-১ পাঠায় তারা। পরের মাসে অর্থাৎ ৩ নভেম্বর পাঠানো হলো দ্বিতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুতনিক-২। এটি ইতিহাসে প্রথম মহাকাশযান, যাতে কোনো জীবন্ত প্রাণী পাঠানো হয় পৃথিবীর কক্ষপথে। সেই প্রাণীটি ছিল একটি ছোট্ট কুকুর, নাম লাইকা।
এ খবর শোনার পর চমকে গিয়েছিলেন ইউরি। ভেবেছিলেন, জীবন্ত প্রাণী যেহেতু মহাকাশে উঠতে পেরেছে, তবে মানুষ কেন পারবে না। তখন থেকেই মনে দানা বাঁধে মহাকাশে পা রাখার স্বপ্ন।
১৯৫৯ সালে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সোভিয়েত সরকার ভস্তক প্রোগ্রাম নামে একটি কর্মসূচি শুরু করে এবং গোপনে নভোচারী নির্বাচনপ্রক্রিয়া চালু করে। বৈমানিকদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া শুরু হয়। কালক্ষেপণ না করে সেখানে আবেদন করেন গ্যাগারিন। সে সময় তাঁর পোস্টিং ছিল মারমানস্ক ওবলাস্টের একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে।
ব্যাপক খাটুনি, পড়াশোনা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল মস্কোর স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৭ মিনিটে বিকট শব্দে কেঁপে উঠল বাইকোনুর কসমোড্রমের মাটি। রুশ সামরিক ক্ষেপণাস্ত্র আর-৭ রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষপেণ করা হলো ভস্তক-১ ক্যাপসুল। ইউরি গাগারিনকে নিয়ে সেটি ছুটে চলল মহাকাশের উদ্দেশে। ককপিটে বসে তিনি উচ্চারণ করলেন তাঁর বিখ্যাত উক্তি—পোইখালি। রুশ এই কথাটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আমরা চলেছি।’
আবেদন করার পরপরই গ্যাগারিনের ডাক পড়ে মস্কোর কাছের এক নির্বাচনী মেডিকেল চেকআপের জন্য। এরপর লম্বা সময়ের অপেক্ষা। চূড়ান্ত বাছাইয়ে ডাক পাবেন কি না, সে আশঙ্কায় কেটেছে অনেক দিন। অবশেষে ডাক এল ২৫তম জন্মদিনের আগে। জন্মদিনে এর চেয়ে ভালো উপহার আর কী হতে পারে? সে কথাই নিজের বইয়ে লিখেছেন এভাবে, ‘জন্মদিনটা খুবই আনন্দের একটা উৎসব। এ উৎসব পালন করে না এমন খ্যাপা আছে হয়তো হাজারে এক। আমার ২৫তম জন্মদিনের প্রাক্কালে পেলাম বিরলতম এক উপহার: মস্কো থেকে আমন্ত্রণ। তার মানে কী সেটা বুঝতে বাকি রইল না।’
এক হাজারের বেশি বৈমানিকের মধ্য থেকে সর্বশেষ যে ২০ জন ভস্তক প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ইউরি গ্যাগারিন। পরে এই ২০ জনকে নিয়ে গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম নভোচারী দল—‘সোচি সিক্স’। তাঁদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর চূড়ান্ত ৬ জনের মধ্য থেকে মানসিক দৃঢ়তা, শারীরিক সামর্থ্য, বিমান চালানোর দক্ষতা ও বিনয়ী ব্যক্তিত্বের কারণে ইউরিকেই চূড়ান্তভাবে বেছে নেওয়া হয়।
ঐতিহাসিক ১০৮ মিনিট
ব্যাপক খাটুনি, পড়াশোনা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল মস্কোর স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৭ মিনিটে বিকট শব্দে কেঁপে উঠল বাইকোনুর কসমোড্রমের মাটি। রুশ সামরিক ক্ষেপণাস্ত্র আর-৭ রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষপেণ করা হলো ভস্তক-১ ক্যাপসুল। ইউরি গ্যাগারিনকে নিয়ে সেটি ছুটে চলল মহাকাশের উদ্দেশে। ককপিটে বসে তিনি উচ্চারণ করলেন তাঁর বিখ্যাত উক্তি—‘পোইখালি’। রুশ কথাটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আমরা চলেছি।’
সকাল ৯টা ১২ মিনিটে ভস্তক-১ পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছায়। ইউরি গ্যাগারিন তখন পৃথিবীর বাইরে, মানুষের প্রথম প্রতিনিধি হয়ে মহাশূন্যে ভাসছেন। নিচে নীল গ্রহ, চারপাশে অসীম নীরবতা। ৯টা ২৫ মিনিটে রেডিওতে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি পৃথিবী দেখছি, কত সুন্দর...কত নীল!’
গ্যাগারিন একবার পৃথিবীকে সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করেন মাত্র ৮৯ মিনিটে। গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৭ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। যার সর্বনিম্ন উচ্চতা ছিল ১৬৯ কিমি ও সর্বোচ্চ ৩২৭ কিমি।
৯টা ৫৫ মিনিটে যানটি আবার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে থাকে। কিন্তু গ্যাগারিন মহাকাশযানে বসে পৃথিবীর মাটিতে অবতরণ করেননি। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় যানটি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছালে তিনি একটি ইজেকশন ব্যবস্থা ব্যবহার করে ১০টা ৫ মিনিটে বেরিয়ে আসেন এবং ১০টা ২০ মিনিটে সারাতভ অঞ্চলের কাছে অবতরণ করেন। এ সময় একজন নারী ও কিশোরী তাঁকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘ভয় পাবেন না, আমি একজন সোভিয়েত নাগরিক, ঠিক আপনাদের মতোই...শুধু মহাকাশ থেকে এসেছি।’
‘জন্মদিনটা খুবই আনন্দের একটা উৎসব। এ উৎসব পালন করে না এমন খ্যাপা আছে হয়তো হাজারে এক। আমার পঞ্চবিংশ জন্মদিনের প্রাক্কালে পেলাম বিরলতম এক উপহার: মস্কো থেকে আমন্ত্রণ। তার মানে কী সেটা বুঝতে বাকি রইল না।’ইউরি গাগারিন, সোভিয়েত মহাকাশচারী
প্যারাস্যুটে অবতরণের এই তথ্য সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ প্রথমে গোপন রেখেছিল। কারণ, তখনকার আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী মহাকাশচারীকে যানসহ নিরাপদে ফিরে আসতে হতো। তা না হলে সেটি প্রকৃত মহাকাশ অভিযান হিসেবে গণ্য হবে না। পরে অবশ্য এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তত দিনে ইউরি গ্যাগারিন বিশ্বের চোখে নায়ক হয়ে উঠেছেন।
রকেট উৎক্ষেপণ থেকে প্যারাস্যুটে অবতরণ পর্যন্ত ইউরি গ্যাগারিনের ঐতিহাসিক মহাকাশ অভিযান ১০৮ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল।
ইতিহাস গড়া মহাকাশযান ভস্তক-১
গ্যাগারিন যে মহাকাশযানে চড়েছিলেন, তার নাম ছিল ভস্তক-১। এটি ছিল এমন একটি মহাকাশ যান, যেটি মাত্র একজন নভোচারীর উপযোগী করে তৈরি। ভস্তক-১-এর ওজন ছিল প্রায় ৪ হাজার ৭২৫ কেজি। এর ভেতরের অংশ ছিল গম্বুজাকৃতির। গ্যাগারিনকে বসানো হয়েছিল একটি বিশেষ আসনে, যা উৎক্ষেপণের ধাক্কা ও মহাশূন্যের চাপে সুরক্ষার জন্য বিশেষভাবে নকশা করা হয়েছিল।
ভস্তক-১-এ কোনো ‘ম্যানুয়াল কন্ট্রোল’ ছিল না, অর্থাৎ গ্যাগারিন নিজে থেকে যানটি চালাতে পারতেন না। এটি ছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত। যাত্রাপথে যদি জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হতো, তবেই তিনি একটি সিল করা খামে থাকা কোড ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করার অনুমতি পেতেন।
ওই অভিযানের প্রায় ৫০ বছর পর রুশ প্রকৌশলী বরিস চেরটক তাঁর লেখা ‘রকেট অ্যান্ড পিপল’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এখনকার বিজ্ঞানীদের সামনে যদি ভস্তক নামের ওই নভোযানটিকে রাখা হতো, কেউই সেটিকে মহাশূন্যে পাঠানোর পক্ষে মত দিতেন না।’
সোভিয়েত অপপ্রচারের ছায়া
গ্যাগারিনের মহাকাশ অভিযান নিঃসন্দেহে ছিল একটি বৈজ্ঞানিক অর্জন। তবে এটিকে রাজনৈতিক অপপ্রচারের অংশ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
সে সময় স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলছিল মহাকাশ প্রতিযোগিতা, যাকে বলা হয় ‘স্পেইস রেস’। মহাকাশ গবেষণায় সোভিয়েতরা মার্কিনদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। আর গ্যাগারিনকে মহাকাশে পাঠানো ছিল সেই প্রতিযোগিতার মোক্ষম চাল।
গ্যাগারিনকে রাষ্ট্রীয় প্রচারে একটি আদর্শ সোভিয়েত নাগরিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাঁর মুখাবয়ব ছাপানো হয় পোস্টারে, মূর্তি গড়া হয় শহর থেকে গ্রাম—সর্বত্র। তাঁকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয় ‘মহাকাশ দূত’ হিসেবে, যাতে সোভিয়েত বিজ্ঞান ও আদর্শ বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা যায়।
গ্যাগারিন আবারও মহাকাশে যেতে চেয়েছিলেন। আবার মহাকাশে যাওয়ার জন্য সয়ুজ মিশনের জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। তবে ১৯৬৭ সালে সয়ুজ–১ মিশনে নভোচারী ভ্লাদিমির কোমারভ নিহত হন। এই দুর্ঘটনার পর মহাকাশ অভিযানের পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় এবং গ্যাগারিনকে আবার কখনো মহাকাশে পাঠানো হয়নি।
মূলত মহাকাশে যাওয়া প্রথম মানব হিসেবে তাঁকে একটি ‘জীবন্ত প্রতীক’ হিসেবে ধরে রাখতে চেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাঁর প্রতি এতটাই শ্রদ্ধা ও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যে সোভিয়েত সরকার তাঁকে আর কোনো ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে পাঠাতে চায়নি।
গ্যাগারিন ছিলেন সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের মুখপাত্র। তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতেন, বক্তৃতা দিতেন এবং বিশ্বজুড়ে মহাকাশবিজ্ঞানের প্রচারে অংশ নিতেন। তিনি পরে মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে রাশিয়ার প্রখ্যাত জুকোভস্কি ইনস্টিটিউট অব অ্যারোনটিক্যালে ভর্তি হয়ে ১৯৬৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
মৃত্যু নিয়ে রহস্য
মহাকাশ থেকে ফেরার পাঁচ বছর পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান ইউরি গ্যাগারিন। ১৯৬৭ সালের ২৭ মার্চ গ্যাগারিন ও তাঁর সহযাত্রী পাইলট ভালেরি বুদানভ একটি মিগ-১৫ যুদ্ধবিমান উড়িয়ে যাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভোরোনেজ অঞ্চলের কাছে বিমানটি দুর্ঘটনার কবলে পড়লে দুজনই নিহত হন। এই দুর্ঘটনা একদিকে যেমন পুরো বিশ্বকে হতবাক করেছিল, তেমনি গ্যাগারিনের মৃত্যুর পেছনে নানা তত্ত্ব ও রহস্যের জন্ম দিয়েছিল।
প্রথম দিকে সোভিয়েত গণমাধ্যম গ্যাগারিনের মৃত্যু নিয়ে একটি সাধারণ বিমান দুর্ঘটনার খবরই প্রচার করেছিল। তবে বেশ কিছু বছর পর, গ্যাগারিনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে এবং একাধিক গুজব তৈরি হয়। ইউরি গ্যাগারিনের জনপ্রিয়তা এতটাই ব্যাপক ছিল যে তাঁর মৃত্যুকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলেও মনে করেন অনেকে।
যা–ই হোক, গ্যাগারিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় প্রধানের বাইরে কারও মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার ঘটনা এটাই প্রথম।
তথ্যসূত্র: (ইউরি গ্যাগারিনের লেখা বই ‘পৃথিবী দেখছি’, ব্রিটানিকা, রুশ মহাকাশ সংস্থা রোসকসমস, নাসা, বিবিসি, আল–জাজিরা)