সফটওয়্যার সুরক্ষার যোদ্ধা

চঞ্চল রায়। ছবি: সংগৃহীত
চঞ্চল রায়। ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজার শহরের সল্ট ক্যাফে। পড়ন্ত বিকেল তখন। সবুজ চায়ে চুমুক দিয়ে চঞ্চল রায় খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েন। দৃষ্টি দেন স্বচ্ছ কাচের জানালায়, যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত সড়ক, মানুষের কোলাহল। বললেন, ‘স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সফটওয়্যার তৈরির ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে চাই, যা মানুষের স্পর্শ ছাড়াই চিন্তার প্রতিফলন ঘটাবে।’

এ–ও কি সম্ভব? চঞ্চল রায়ের চেহারায় দৃঢ়তা। বললেন, ‘জানি না কতটুকু সফল হব। তবে এ রকম একটি স্বপ্ন আছে আমার।’

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চঞ্চল রায় অধ্যাপনা করেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ানের কম্পিউটার বিজ্ঞান অনুষদে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন গবেষণার একটি কাজে। ফাঁকে ঘুরে যান কক্সবাজার। ২ ফেব্রুয়ারি কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

চঞ্চল রায়ের কাজটা হলো কম্পিউটার সফটওয়্যারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তিনি তৈরি করেছেন সফটওয়্যারের বাগ (ত্রুটি) এবং ক্লোন (অনুরূপ, কিন্তু আসল নয়) ধরার প্রোগ্রাম ‘নাইক্যাড’। যা কম্পিউটার প্রোগ্রামার বা সফটওয়্যার নির্মাতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। ২০০৮ সালে তিনি এই প্রোগ্রাম বা টুল তৈরি করেন। নাইক্যাড–এর রেফারেন্স (উদ্ধৃতি) দিয়েছে বিশ্বের ৫৫০টি গবেষণা প্রবন্ধ। নাইক্যাড নামানো (ডাউনলোড) হয়েছে ২ হাজার ৫০০ বারের বেশি।

এ ছাড়া প্রোগ্রামিংয়ের সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি তৈরি করেন ‘ক্রোকেজ’ নামের আরেকটি প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে বড় ওয়েবসাইট যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টাক ওভারফ্লোর সাইটে এটি প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে প্রোগ্রামিং সমস্যার সহজে সমাধান করা যায়। এগুলো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রযুক্তি–বিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট টেক রিপাবলিক, এসডি টাইমস, এসিএম টেক নিউজ ও আইপ্রোগ্রাম ইনফো।

চঞ্চল রায় বলেন, ‘এক যুগের বেশি সময় ধরে মূলত সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ ও মূল্যায়নের ওপর কাজ করে যাচ্ছি। আমার মূল গবেষণার ক্ষেত্র সফটওয়্যার ক্লোন শনাক্ত ও বিশ্লেষণ, বাগ প্রতিরোধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বড় পরিসরের তথ্য ব্যবস্থাপনা ও বিশ্লেষণ ইত্যাদি। আমাদের প্রোগ্রাম প্রায় নির্ভুলভাবেই ক্লোন শনাক্ত করে সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণকে গতিশীল ও সহজ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষার সফটওয়্যার ক্লোন শনাক্ত করার কাজ আরও দ্রুততার সঙ্গে বড় পরিসরে করতে সক্ষম হয়েছি, যা গবেষণায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এরই মধ্যে মাইক্রোসফট আমাদের টুল ব্যবহার করছে।’

যত স্বীকৃতি

তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে কানাডার সেরা তিন নবীন গবেষকের একজন নির্বাচিত হন তিনি। কম্পিউটার বিজ্ঞানে কানাডার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সিএস-ক্যান/ইনফো-ক্যান ২০১৯ সালের তাঁকে ‘আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং কম্পিউটার সায়েন্স রিসার্চার’ পুরস্কার দেয়। ২০১৮ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ান থেকে পান ‘নিউ রিসার্চার’ ও ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ বিজ্ঞানী পুরস্কার। ২০১৮ সালে চঞ্চল রায়ের কাজের স্বীকৃতি আসে ‘আইইইই’–এর দুটি সম্মেলন থেকেও। সুইডেনের গোথেনবার্গে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘টেন ইয়ার মোস্ট ইনফ্লুয়েন্স পেপার (এমআইপি)’ পুরস্কার। একজন গবেষকের ১০ বছরের কাজের ভিত্তিতে এই স্বীকৃতি মেলে। নাইক্যাডের জন্য তিনি এটি পেয়েছেন।

ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ানের বিলবোর্ডে চঞ্চল রায়। ছবি: সংগৃহীত
ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ানের বিলবোর্ডে চঞ্চল রায়। ছবি: সংগৃহীত


রংপুর থেকে কানাডা
রংপুর সদরের যাদবপুর গ্রামে তাঁর বেড়ে ওঠা। বাবা ছিলেন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। এরপর শ্যামপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন। উচ্চশিক্ষার পাঠ শুরু হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। স্নাতক হওয়ার পর বছর তিনেক শিক্ষকতা করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর পাড়ি জমান জার্মানি। আখেন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে নেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এরপর পিএইচডি করেন কানাডার কুইনস বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি শেষ হওয়ার আগেই যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ানে। তাঁর স্ত্রী বনানী রায়ও অধ্যাপনা করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দম্পতির দুই মেয়ে।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পাশে

চঞ্চল রায় ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ানে যোগ দেন ২০০৯ সালে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খুব একটা জায়গা পেতেন না। তাঁর উদ্যোগে এখন সাসকাচোয়ানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২০০ জন। তাঁর হাত ধরে ২০১০ সালে গড়ে উঠে শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাট দ্য
ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ান (বিএসএইউএস)’।

বর্তমানে তাঁর অধীনে পিএইচডি ও এমএসসি করছেন ১৮ জন। এর মধ্যে ১৫ জনই বাংলাদেশি।

নিজের ল্যাবে চঞ্চল রায়। ছবি: সংগৃহীত
নিজের ল্যাবে চঞ্চল রায়। ছবি: সংগৃহীত


নিজেকে ছাড়িয়ে
গবেষণার নতুন দিকেও নজর দিয়েছেন চঞ্চল রায়। ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচোয়ানে এখন খাদ্য ও পানি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা গবেষক দলের অন্যতম প্রধান তিনি। ১১৪ কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে এ দুটি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা। এতে বিভিন্ন খাদ্যশস্যে দুর্যোগ–সহনশীল নতুন জাত তৈরিতে কাজ করছেন এই গবেষক দল। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদন সঠিকভাবে পরিচালিত করার পথ বাতলে দেবেন তাঁরা। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে বাংলাদেশও। সম্প্রতি এ নিয়ে বাংলাদেশি গবেষকদের প্রশিক্ষণ দিতে দেশে এসেছেন। বাংলাদেশি গবেষকদের প্রশিক্ষিত করতে সই হয়েছে সমঝোতা স্মারক।

লক্ষ্য বহুদূর

চঞ্চল রায় বলেন, ‘সফটওয়্যার ত্রুটি থাকার কারণে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্সের দুটি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ছিল সফটওয়্যারের বাগ। ২০১৭ সালে ৬০৬টি সফটওয়্যার বাগের জন্য ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। ক্ষতি হয়েছিল ৩৭০ কোটি মানুষ ও ৩১৪টি কোম্পানি। এ জন্য একেবারে বাগ ছাড়াই সফটওয়্যার তৈরিতে কাজ করছি আমরা।’

শেষে আসেন আবারও সেই স্বপ্নের কথায়—‘স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির সফটওয়্যার, যেখানে মানুষের স্পর্শ ছাড়াই ঘটবে চিন্তার প্রতিফলন।’