‘টপাটপ লাফিয়ে নামল ৪০/৫০ জন পাক সৈন্য। এবার বুঝতে বাকি রইল না ওদের শিকার এখন আমরা...হাত–পা অবশ হয়ে এল। বুঝলাম মৃত্যু এখন আমাদের অবধারিত। তবু সাহস হারালে তো চলবে না।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও ভাইকে হারানো একাত্তরের সেই দিনগুলোতে স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন বইতে এভাবেই তুলে ধরেছেন বেগম মুশতারী শফী।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন স্মৃতিনির্ভর গ্রন্থ, নিবন্ধ ও গবেষণার শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে স্মৃতিগ্রন্থই বেশি। তুলনামূলকভাবে কম গবেষণার সংখ্যা।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, প্রথম আলোর নিজস্ব গ্রন্থাগার এবং শ্রাবণ প্রকাশনীর সংগ্রহে থাকা বইগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বইগুলোর একটি বড় অংশের লেখক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নারীরা।
শহীদ পরিরবারে সদস্য জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি বইটির ভূমিকায় যথার্থভাবেই লেখা হয়েছে, ‘নিছক দিনলিপি নয়। জাতির হৃদয় ছবি ফুটে উঠেছে এখানে।’
একাত্তরের শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী—শহীদ বুদ্ধিজীবী আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর লেখা আরেক স্মৃতিগ্রন্থ। শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী গুহ ঠাকুরতার লেখা একাত্তরের স্মৃতি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার স্বাক্ষর। তালিকায় আছে শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সারের মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে।
নারী সাহিত্যিকদের কলমে উঠে এসেছে যুদ্ধের স্মৃতি। কবি সুফিয়া কামালের বই একাত্তরের ডায়েরি। একাত্তরের ঢাকা সাহিত্যিক সেলিনা হোসনের স্মৃতিকথা। অবরুদ্ধ জনপদের দিনলিপির বয়ান আনোয়ারা সৈয়দ হকের অবরুদ্ধ।
ফরিদা হকের জার্নি থ্রু ১৯৭১ : মাই স্টোরি বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে বা পশ্চিম পাকিস্তানে অবরুদ্ধ থাকার স্মৃতিকথাও উঠে এসেছে।
কিশোরী বয়সে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমির আমার ছোটবেলা, উনিশশ একাত্তর এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ নিছক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা নয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গবেষক রেজিনা বেগম মনে করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যে চিত্র নারীরা তুলে ধরেছেন, তা এক অন্য রকম যুদ্ধকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ মনে করেন, নারীদের এসব স্মৃতিগাথার গুরুত্ব অনেক।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭১–এর ১৯ ধারায় বলা আছে, আদালত চাইলে এসব দলিল গ্রহণ করতে পারেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর অবদান শাহনাজ পারভিনের পিএইচডি গবেষণা। জোবাইদা নাসরীনের গবেষণামূলক বই হলো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নারী, মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য নারী।
সেলিনা শিউলীর বগুড়া জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রীতা ভৌমিকের মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ, জোবাইদা নাসরীনের মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালী এমন কয়েকটি আঞ্চলিক ইতিহাসের বই। শঙ্করী দাসের গণমানুষের স্মৃতিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একটি ইতিহাসগ্রন্থ।
নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন। ভোলা জেলা নিয়ে রেহানা পারভীন, নাটোর জেলা নিয়ে সুমা কর্মকার এবং রোকনুজ্জামান বাবুলের সঙ্গে শিউলি খাতুন করেছেন পাবনা জেলার জরিপ গ্রন্থটি।
১৯৭১ গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকেন্দ্র দেশের বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপের কাজ করেছে।
এই জরিপ কাজের তত্ত্বাবধান করা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা নারীদের একটি বড় কাজের ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে।’