সোনা ঠিকই গাছে ধরে
কথায় বলে, ‘টাকা কি গাছে ধরে?’ সাধারণত বিরক্তিসূচক ভঙ্গিতে এ প্রশ্ন তোলা হয়। যার উদ্দেশে তোলা হয়, তাকে বেজার মুখে মুহূর্তেই স্বীকার করে নিতেই হয় যে ‘না, টাকা গাছে ধরে না।’ কিন্তু এখন এর বদলে আরেকটি চটপট জবাব দেওয়া যেতে পারে। বলা যেতে পারে, ‘টাকা না হোক, সোনা ঠিকই গাছে ধরে। না হয় সোনা বেচেই টাকা নেব।’ না, কোনো হেঁয়ালি নয়। এ তথ্য জানাচ্ছেন গবেষকেরাই।
ধারণাটি অবশ্য অনেক পুরোনো। সুদিন যখন ছিল, তখন মানুষ মাটিতে দাগের দিকে তাকিয়ে থাকত। এসব দাগ বিশ্লেষণ করত। কারণ, এই দাগের মধ্যেই লুকিয়ে থাকত ভূগর্ভের কোনো রত্নভান্ডারের ইঙ্গিত। এভাবে সহজলভ্য উৎসগুলো ক্রমেই মানুষের নাগালে চলে আসে। ফলে মানুষকে নামতে হয় আরও সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের খোঁজে। এ জন্য তাকে এবার কাদা-জল মাড়িয়ে সোনার খনির সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বের করতে সাধনায় নামতে হয়। কিন্তু তাও তো হয়ে গেল অনেক দিন। এল ড্রিল মেশিন। পাওয়া গেল ইঙ্গিতের নতুন উৎস। ভূপৃষ্ঠে থাকা বিভিন্ন গর্তে জমা পানি বিশ্লেষণ করে সোনার অস্তিত্ব পাওয়ার উপায় জানল মানুষ। সঙ্গে নিজের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্রতম সম্ভাবনা রয়েছে, এমন স্থানেও ছিদ্র করে সোনার খোঁজে নামল মানুষ। এভাবে ধাপে ধাপে সম্ভাব্য প্রায় সব উপায়ই কাজে লাগানো হয়েছে। ভূগর্ভ থেকে তুলে আনা হয়েছে তাল-তাল সোনা। কিন্তু মানুষের খিদে মিটল না।
কথা হলো আজন্ম স্বর্ণের পেছনে মানুষ ছুটছে কেন? সহজ উত্তর ক্ষয় খুব কম। ফলে অন্য ধাতুর মতো সময়ের সঙ্গে এর ভরে তেমন পরিবর্তন হয় না। আর ঔজ্জ্বল্য তো রয়েছেই। এ দুই মিলে জগৎ সেই আদিকাল থেকে ছুটছে সোনার পিছে। এটা এতটাই যে গণিত থেকে শুরু করে চিত্রকলা, কবিতা সবকিছুতেই স্বর্ণকেন্দ্রিক একটা উপমা খুঁজে পাওয়া যাবেই। গণিতে যদি দেখা দেয় ‘সোনালি সমীকরণ’, তো চিত্রকলায় আসবে ‘সোনালি অনুপাত’। চলচ্চিত্রের কথা বলবেন; সেখানেও আছে স্বর্ণযুগ! আর কবিতায় খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে, এই স্বর্ণের উপমাই দেশ-কালভেদে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। সোনার প্রতি মানুষের অনুরাগ বুঝতে ওপরের উদাহরণগুলোই যথেষ্ট বোধ হয়।
তাই নতুন নতুন সোনার খনি খোঁজাটা মানুষের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন এই খোঁজাখুঁজিটা কঠিন হয়ে গেছে। খনি রয়েছে এমন ইঙ্গিত পাওয়াটাও এখন বিরাট ব্যাপার। প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, কিন্তু ব্যয়ের কথাও তো ভাবতে হবে। তাই সোনার খনি খুঁজে বের করার একটা সহজ পথ খুঁজছিল মানুষ অনেক দিন থেকেই। এই খোঁজই এবার দিলেন গবেষকেরা। অনেক আগেই বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, সোনার খনি খুঁজতে আর নিচে নয়, এবার ওপরে তাকাতে হবে। ওপরে মানে আকাশে নয়, গাছে। আরও ভালো করে বললে গাছের পাতায়। কিন্তু ওটুকুই। কোনো সাফল্য আসছিল না এ পথে। কোনো সুনির্দিষ্ট সমীকরণ পাওয়া যাচ্ছিল না, যাকে বলে ‘গোল্ডেন ইকুয়েশন’। এবার সেই সমীকরণের পথই বাতলালেন অস্ট্রেলিয়ার গবেষকেরা।
গাছের পাতায় ভূগর্ভস্থ সোনার খনির খোঁজ পাওয়ার প্রথম ধারণাটি এসেছিল ১৯৪০-এর দশকে। কিন্তু ২০১৯ সালের আগে তার কোনো বাস্তব প্রয়োগ পাওয়া যায়নি। এই ধারণার মূল কথা হলো, কিছু গাছ রয়েছে, যেগুলো মাটির অনেক নিচ থেকে পানি সংগ্রহ করে; সেই সঙ্গে খনিজও, যার অবশেষ কিনা থেকে যায় পাতায়। ফলে ভূগর্ভে কী ধরনের খনিজ পদার্থ রয়েছে, তার একটি ধারণা পাওয়া যেতে ওই গাছের পাতা বিশ্লেষণে। এই বিশ্লেষণেই এবার সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, কোনো স্থানের গাছের পাতায় যদি দশমিক ১৫ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) পরিমাণ সোনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তবে বুঝতে হবে, সেখানে কোনো সোনার খনির দেখা মিলবে না। আর যদি এ পরিমাণ ৪ পিপিবি হয়, তবে বুঝতে হবে নিশ্চিত পাতাটিই ‘ওড়ানো’ হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা ২০১৩ সালেই বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক সাফল্য পান। ওই বছর নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার কিছু অঞ্চলে কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআরও) ও কেনসিংটনের সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষকেরা কাজ করেন। তাঁরা সেখানকার একটি স্বর্ণখনির ওপরে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা, বাকল ও কাণ্ড পরীক্ষা করেন। ভূগর্ভের ৩০ মিটার নিচে থাকা সোনার খনির কারণে এসব নমুনায় তাঁরা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি স্বর্ণের অস্তিত্ব পান। খনির ওপরে থাকা গাছের পাতায় তাঁরা ৮০ পিপিবি স্বর্ণের অস্তিত্ব পান। অথচ এই খনির ২০০ মিটার দূরের গাছে পান অনেক কম পরিমাণ সোনার অস্তিত্ব।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো জায়গায় সোনার খনি আছে কি না, থাকলেও তা কতটা বড়, তা নির্ধারণে খোঁড়াখুঁড়ির বদলে আগাম বার্তা পেতে এখন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গাছের পাতা পরীক্ষাই যথেষ্ট। বিশেষত শুষ্ক অঞ্চলে এ পদ্ধতি বেশি কার্যকর। কারণ, শুষ্ক অঞ্চলের গাছগুলোকে পানি সংগ্রহের জন্য মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত শিকড় বিস্তৃত করতে হয়। আর এই পানি সংগ্রহের সঙ্গেই তারা স্বর্ণ আহরণের কাজটি করে ফেলে। এ পদ্ধতিতে শুধু স্বর্ণই নয়, বিসমাথ, অ্যান্টিমনির মতো ধাতুর খনির জানানও পাওয়া যাবে।
এ পদ্ধতির একটাই সংকট। একেক প্রজাতির গাছ একেক পরিমাণে খনিজ আহরণ করে। ফলে, গাছের জাত বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় এর পাতায় সঞ্চিত খনিজের পরিমাণ। তাই কোনো খনিজ পদার্থের খনি রয়েছে কি না, জানতে হলে সুনির্দিষ্ট একটি প্রজাতির গাছের পাতাই বিশ্লেষণ করাই জরুরি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে বিপদে পড়েন এই কারণেই। অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাকাশিয়ার মোটামুটি হাজারটি জাত রয়েছে, যার একটি বড় অংশই দেখতে প্রায় একই রকম। ফলে পাতায় সঞ্চিত স্বর্ণের পরিমাণ দিয়ে, খনি খোঁজার কাজটি কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে যত কঠিনই হোক না কেন, খনির খোঁজ মোটামুটি সঠিকভাবেই পাওয়া সম্ভব এ পদ্ধতিতে। খনিতে থাকা মজুতের পরিমাণ সম্পর্কেও একটা খসড়া ধারণা করা সম্ভব। ফলে এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সোনার খনির প্রাথমিক খোঁজটি ঠিকই মিলবে। খনির খোঁজ পেলে পরে না হয় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করা যাবে। কারণ, খনি পেলে তো ব্যয়ে কোনো সংকট নেই। এ কারণে অস্ট্রেলিয়ার খনি কোম্পানি মারমোটা এরই মধ্যে এ পদ্ধতির প্রয়োগ শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অরোরা ট্যাংক সাইটে তারা পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতির প্রয়োগ করবে বলে জানিয়েছে।