সমস্যা যখন ভার্চ্যুয়াল অবসাদ
মানুষের জীবনে প্রযুক্তি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা মহামারিতে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বেড়েছে। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগে, শিক্ষায়, শিশুদের বিনোদনে, এমনকি বাড়িতে বসে অফিসের কাজে প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে মানুষ। কিন্তু সীমাহীন ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগের ফলে মানুষের মধ্যে ‘জুম ফ্যাটিগ’ নামে একধরনের ভার্চ্যুয়াল অবসাদ বা ক্লান্তি তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। ডিজিটাল এই অবসাদ ঠেকাতে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন প্রযুক্তিগত সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে। মানুষকে যাতে স্ক্রিন বা পর্দায় কম সময় উপস্থিত থাকতে হয় এবং কাজে উৎপাদনশীলতা ও সৃজনশীলতা বাড়ে, তারই লক্ষ্যে কাজ করছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাইক্রোসফট তাদের আউটলুক সেবায় নতুন টুল বা প্রোগ্রাম এনেছে, যা মানুষকে মিটিং সংক্ষিপ্ত করে যথেষ্ট বিরতি নেওয়ার সুবিধা দেয়। এতে যে সেটিংস আছে, তাতে এক ঘণ্টার মিটিংয়ের পর পাঁচ মিনিট করে বিরতি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কলের মধ্যে সাধারণ বিরতির সুবিধাও আছে। মাইক্রোসফটের নিজস্ব একটি গবেষণার পর নতুন এই টুল সৃষ্টি করা হয়। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, পরপর একাধিক ভার্চ্যুয়াল মিটিং কর্মীর ওপর চাপ বাড়ায় ও তাঁর মনোযোগ নষ্ট করে।
টানা চারটি বিরতিহীন আধা ঘণ্টার মিটিংয়ের পর গবেষকেরা ১৪ জন কর্মীর মস্তিষ্ক স্ক্যান করেন। এরপর প্রতিটি মিটিংয়ের পর ১০ মিনিট করে বিরতি দিয়ে আবার মস্তিষ্ক স্ক্যান করেন। বিশ্লেষণে দেখা যায়, মিটিংয়ের মধ্যে বিরতি না নিলে কর্মীর চাপের পরিমাণ বেড়ে যায়।
মাইক্রোসফট যুক্তরাজ্যের মডার্ন ওয়ার্ক বিষয়ের প্রধান নিক হেডারম্যান বলেন, ‘স্ক্রিন থেকে শারীরিকভাবে বিরতি নেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। বিরতি নিয়ে কোনো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে।’ তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, অফিসের নেতারা দূরে থাকা কর্মীদের মধ্যে ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ার জন্য মিটিং ২০ থেকে ৪০ মিনিটে নামিয়ে আনতে পারেন। কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন টিম চেক-ইন সিস্টেম গড়তে পারেন। এ ছাড়া শুধু গলা শোনা যাবে, এমন মিটিং করতে পারেন, যাতে স্ক্রিন সময় কমিয়ে শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি উন্নত করা যায়।
অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সাবেক নির্বাহী সহকারী নাজ বেহেশতি বলেন, ‘যদি আমরা আমাদের আচরণ সম্পর্কে সচেতন হই এবং পরিষ্কার সীমানা এবং সময়সূচি স্থাপন করি, তবে আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার বদলে পক্ষে আনতে পারি।’
এর আগে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ফোন ও নোটিফিকেশনে উত্পাদনশীলতা ও মনোযোগে ক্ষতিকারক প্রভাব রয়েছে। এ ধরনের গবেষণা আরও বাড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দেখেছেন, একটি নোটিফিকেশনের পর কাজে ফিরতে ২৩ মিনিট করে সময় লাগে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নোটিফিকেশন এলে তা থেকে ফিরতে সময় লাগে। কাজে ভুল হয়, চাপ বাড়ে।
এ ক্ষেত্রে অ্যাপল ও গুগল স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অ্যাপল স্ক্রিন টাইম ফিচার ও অ্যান্ড্রয়েড ডিজিটাল ওয়েলবিং টুল দিয়ে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যবহারকারীর ডিভাইস থেকে কোন অ্যাপে কত সময় কাটালেন, তা দেখা নিতে পারেন। এ ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দিতেও পারেন।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নোটিফিকেশন না এলেও শুধু ফোনই মনোযোগ নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাঁদের কাছে নোটিফিকেশন বন্ধ রাখার উপায় নেই, তাঁরা ‘লাইট ফোন’-এর মতো সাধারণ ফিচার ফোন ব্যবহার করতে পারেন। এ ধরনের ফোন স্মার্টফোনের মনোযোগহীনতা কাটাতে পারে। এ ধরনের ফোনে শুধু কল, টেক্সট, অ্যালার্ম ও মোবাইল হটস্পট সুবিধা আছে। এতে ক্যালকুলেটর বা মিউজিক প্লেয়ার যুক্ত করা যায়। তবে এতে সোশ্যাল মিডিয়া নেই। এতে ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সুবিধাও নেই। এ ধরনের ফোনের বাজার বাড়ছে মহামারিতে।
এর সহ-উদ্যোক্তা কাইওয়ে ট্যাং বলেন, সমস্যা হচ্ছে, মানুষ এখনো লকডাউনে রয়েছে। ৫০ শতাংশ লাইট ফোন ব্যবহারকারী কেবল সপ্তাহান্তে তা চালু করে যখন তারা বিরতিতে থাকে।
গবেষকেরা বলছেন, অনেকেই কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে বিরক্তি পছন্দ করেন না। এ ধরনের মানুষ এখন বাড়ছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ডানকান ব্রামবি বলেন, গভীর মনোযোগসম্পন্ন কাজের ক্ষেত্রে নোটিফিকেশনের মতো বিরক্তকর কিছু যাতে না ঘটে, তা খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
টুইটারের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রুস ডেইসলি বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতি সৃজনশীল কাজের সুবিধা দিলেও সবার জন্য তা মানানসই নয়। কর্তৃপক্ষের ই-মেইল বা কলের উত্তর না দিলে চাকরি নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে।