যে প্রযুক্তিগুলো চমকে দেবে এ বছর
একটি বছর বিদায়ের পরই শুরু হয়ে যায় নতুন বছরে কী কী চমক আসতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা। গেল বছরটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে অন্যতম আলোচিত বছর ছিল। বেশ কিছু উদ্ভাবনী প্রযুক্তির দেখা মিললেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কয়েকটি বৃহৎ কেলেঙ্কারিরও খবর মিলেছে। ২০১৯ সালেও বেশ কিছু প্রযুক্তি আমাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। চলতি বছর মোবাইল ফোন ডিভাইসের মেকানিক্যাল স্লাইডার এবং দ্রুতগতির ডিসপ্লে, পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ফাইভ-জি ও স্মার্ট ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, আরও উন্নত অগমেন্টেড রিয়েলিটি হেডসেট এবং ফোল্ডেবল স্ক্রিন ও ডিভাইস বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে চমক সৃষ্টি করবে বলে মত প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞদের।
ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট
ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে। এ বছর এটি আরও উন্নত হয়ে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিভাইস এখন একটি পরিবারের একাধিক সদস্যের ভয়েস কমান্ড শনাক্তের সক্ষমতা অর্জন করবে। এর ফলে একেকজনের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা দিতে পারবে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট। চলতি বছর স্মার্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট স্মার্টফোনের পাশাপাশি সব ধরনের প্রযুক্তিপণ্য ছড়িয়ে পড়বে। স্মার্ট টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মিডিয়া প্লেয়ার, গাড়ি, ডিজিটাল প্রজেক্টর ও অ্যাকশন ক্যামেরার মতো ডিভাইসে ভার্চ্যুয়াল সহকারী ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রযুক্তির দেখা মিলবে।
ওয়াটারড্রপ নচ
গেল বছর স্মার্টফোন ডিভাইসে প্রথম নচ ডিসপ্লের দেখা মেলে। নচ ডিসপ্লের সুবিধা হলো, ডিভাইস ডিসপ্লের ওপরের অংশের মাঝবরাবর খুব অল্প জায়গার মধ্যে ক্যামেরা, ইয়ারপিস ও অ্যামবিয়েন্ট লাইট সেন্সর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর সুবাদে ডিভাইসের আকৃতি না বাড়িয়ে বড় স্ক্রিনের ডিসপ্লে ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। তবে চলতি বছর ডিসপ্লের নচ আরও ছোট হয়ে আসবে। ওয়ানপ্লাসের পাশাপাশি হুয়াওয়ে, ভিভো ও অপোর মতো মোবাইল ফোন ডিভাইস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াটারড্রপ নচ ডিসপ্লের হ্যান্ডসেট বাজারে এনেছে। চলতি বছর দেখা মিলতে পারে ডুয়াল ডিসপ্লে।
৯০ ও ১২০ হার্টজ ডিসপ্লে
ডিভাইস ব্যবহারকারীরা অনেকেই দিনভর ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছু ডিভাইস নির্মাতার ডিসপ্লে অন্যদের চেয়ে উন্নত। সাশ্রয়ী থেকে প্রিমিয়াম সব হ্যান্ডসেটে এখন উচ্চ রেজল্যুশন, উজ্জ্বল ও হাই-এন্ড অর্গানিক লাইট-এমিটিং ডায়োড (ওএলইডি) ডিসপ্লে দেখা যায়। প্রচলিত সব ধরনের ডিসপ্লেরই একটি ঘাটতি রয়ে গেছে, তা হলো রিফ্রেশ রেট। ডিসপ্লের জন্য আদর্শ রিফ্রেশ রেট হলো ৬০ হার্টজ। অর্থাৎ কেউ যখন স্মার্টফোন ডিসপ্লেতে কোনো ছবি দেখেন, তখন এই আদর্শ রিফ্রেশ রেটের ডিসপ্লে প্রতি সেকেন্ডে ৬০ বার ওই ছবিকে রিফ্রেশ করে। রিফ্রেশ রেট বাড়ানো হলে কনটেন্ট দেখার সময় ঝাপসাভাব দূর করবে। বাড়বে ডিসপ্লের গতি। ৯০ কিংবা ১২০ হার্টজের ডিসপ্লে ব্যবহার করলে কেউ আগের স্ট্যান্ডার্ডে ফিরে যেতে চাইবেন না। চলতি বছরই রিফ্রেশ রেটের ডিসপ্লের হ্যান্ডসেট বাজারে মিলবে।
উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারি ও দ্রুত চার্জিং প্রযুক্তি
ডিভাইসে ব্যাটারির সক্ষমতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে এ বছরই। দ্রুত চার্জিং প্রযুক্তিও আরও উন্নত হবে। গত বছর সব ধরনের মোবাইল ফোনেই শক্তিশালী ব্যাটারির দেখা মিলেছে। একই সঙ্গে ডিভাইস ব্যাটারি উত্তপ্ত হওয়ার যে সমস্যা, তার স্থায়ী সমাধান মিলতে পারে।
ডিজিটাল আসক্তি
ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তির কারণে স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ বছর ডিভাইস আসক্তির স্থায়ী সমাধান আসতে পারে। অর্থাৎ ব্যবহারকারী ডিভাইস স্ক্রিনে কত সময় ব্যয় করছেন, তা এখন সফটওয়্যারের মাধ্যমে জানা যায়। চলতি বছর ডিভাইসেই বিল্টইন ফিচার মিলবে, যা সহনীয় মাত্রার বেশি সময় ডিভাইস ব্যবহার করলে ব্যবহারকারীকে সতর্ক করবে। ডিভাইস ব্যবহার করে কোন অ্যাপে কত সময় ব্যয় করা হচ্ছে, তার বিস্তারিত তথ্য জানাবে ফিচার।
ফাইভ-জি
পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ফাইভ-জি উন্নয়নে কার্যক্রম কয়েক বছর ধরে চলছে। এ বছর দ্রুতগতির এ নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হবে। বিদ্যমান ফোর-জি নেটওয়ার্কের চেয়ে ফাইভ-জিতে শতগুণ দ্রুতগতির সেবা মিলবে। ফাইভ-জির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার শুরু হলে অপটিক ফাইবার কেব্ল সংযোগের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অগমেন্টেড রিয়েলিটি
গভীর সমুদ্রে সাঁতার কাটা কিংবা মঙ্গলের বুকে হেঁটে আসা এখন আর কঠিন কিছু নয়। সত্যি সত্যি না হলেও কৃত্রিমভাবে এই অভিজ্ঞতা দিচ্ছে ভিআর। কম্পিউটার সিস্টেম ব্যবহার করে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করার এই প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। ত্রিমাত্রিক ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ার এই অভিজ্ঞতা সামনে আরও নানা কাজে আসবে। এআর-এর বেলায়ও একই কথা খাটে। বিশেষ করে পোকেমন গো গেমটি যাঁরা খেলেছেন, তাঁরা আরও ভালো জানেন এটা। আর এই দুই প্রযুক্তি নিয়ে তৈরি হচ্ছে এমআর বা মিক্সড রিয়েলিটি। মাইক্রোসফট এরই মধ্যে এটা নিয়ে কাজ করছে। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি বা ভিআর হেডসেট এখন অনেকের হাতেই পৌঁছেছে। চলতি বছর এর স্থান দখলে নিতে পারে আরও উন্নত অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) প্রযুক্তি।
ফোল্ডেবল ডিসপ্লে
বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজারে ফ্লেক্সিবল কিংবা ভাঁজ করা যাবে এমন ডিসপ্লের হ্যান্ডসেট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক স্যামসাং থেকে শুরু করে হুয়াওয়ে ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠান ফোল্ডেবল হ্যান্ডসেট উন্মোচনে কাজ করছে। চলতি বছরই ফোল্ডেবল ডিসপ্লের ডিভাইস মিলবে, যা স্মার্টফোনের পাশাপাশি ফোল্ড খুলে ট্যাবলেট ডিভাইস হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।
ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি)
বস্তু, যন্ত্র এবং অন্যান্য উপাদানের মধ্যে বৃহৎ নেটওয়ার্কই হলো আইওটি। এগুলোর মধ্যে সফটওয়্যার, সেন্সর এবং ইলেকট্রনিকসের সাহায্যে তথ্য আদান-প্রদান করানোই আইওটির কাজ। নতুন দিনের এই প্রযুক্তি ২০১৯ সালেও বড় প্রভাব ফেলবে। প্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, ‘আইওটি আমাদের জীবনে বড় রূপান্তর আনতে যাচ্ছে।’ তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান সিসকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরবর্তী দশকে প্রযুক্তিশিল্পে আইওটির বাজারমূল্য হবে ১৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
রোবট গাড়ি
মানুষ চালকের দিন বোধ হয় শেষ হয়ে এল। ভবিষ্যতের রাস্তায় গাড়ি চলবে নিজের বুদ্ধিতেই। অটোমোবাইলের দুনিয়ায় ইলেকট্রিক্যাল গাড়িগুলোই মূলত এই চমক নিয়ে হাজির হচ্ছে। ইলন মাস্কের টেসলা তো বিস্ময়ে মানুষের মুখ রীতিমতো হাঁ করে দিচ্ছে ইদানীং। মেশিন ল্যাংগুয়েজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উন্নত সেন্সর এবং নতুন ধরনের চালিকাশক্তির সমন্বয় হলো রোবট গাড়ি। ফলে এখন অটোপাইলট দিয়েই দিব্যি পথ পাড়ি দেওয়া যাবে। ২০১৯ সালে এই প্রযুক্তি আরও জনপ্রিয় হবে।
ব্রায়ান মাইক্রোচিপ
কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইলেকট্রনিকসের সমন্বয়ে কাজ করবে ব্রায়ান মাইক্রোচিপ। এই প্রযুক্তি মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত হবে; কাজ করবে প্রোগ্রামিং সিস্টেম দ্বারা। ফলে অদূরভবিষ্যতে মাইক্রোচিপটি দিয়ে আরও তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে মানব মস্তিষ্কে। মার্কিন প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ইনটেলের অনুমান, ২০১৯-২০ সালেই ব্রায়ান মাইক্রোচিপের প্রয়োগ দেখা যাবে। ইতিমধ্যে মানব মস্তিষ্কে মাইক্রোচিপটি স্থাপন করার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। এর ফলে মস্তিষ্কে তথ্য সংরক্ষণ অথবা স্নায়বিক তৎপরতা পরিচালনার মতো কাজও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বিশ্বের অনেক জরিপে বলা হচ্ছে, পৃথিবীর সাম্প্রতিক এই প্রযুক্তি বড় প্রভাব ফেলবে এ বছর। তথ্যসূত্র: ইকোনমিক টাইমস ও বিডিজাটাইউ