তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ পরিবর্তন আসছে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের নানা উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায়। তাঁদের হাত ধরেই দেশে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। এতে দ্রুত বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন খাত। যেমন : তরুণ লেমুনুজ্জামান কুষ্টিয়ার আল্লার দরগার প্রত্যন্ত এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান দিচ্ছেন। তিনি জানালেন, নিজের এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ হিসেবে বেসিক কম্পিউটার, গ্রাফিকস ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মতো নানা কাজ শেখানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি। তাঁর মতো অনেক তরুণই দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে রাখছেন বিশেষ ভূমিকা।
সম্প্রতি আর্মেনিয়ার বিসিজি সিনিয়র পার্টনার ও গ্লোবাল লিডার ফর ডিজিটাল গভর্নমেন্ট মিগুয়েল কারারসকো বলেন, প্রযুক্তি কর্মসংস্থান তৈরি করে। আগামী দিনে যে রকম কাজ হবে, এর ১০ শতাংশ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ২০ শতাংশ করবে প্রযুক্তি। বাকি ৭০ শতাংশের জন্য মানুষকেই লাগবে। অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম কোরসেরার বৈশ্বিক দক্ষতা সূচক বা ‘গ্লোবাল স্কিলস ইনডেক্স ২০১৯’ (জিএসআই) অনুযায়ী, প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক থেকে অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ। ওই তালিকায় বাংলাদেশসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর পারফরম্যান্স তুলে ধরা হয়েছে। ওই সূচকে দেখানো হয়েছে, ৯০ শতাংশ উন্নয়নশীল অর্থনীতি এখন ক্রিটিক্যাল স্কিল বা জটিল দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে যাচ্ছে বা ঝুঁকিতে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতার ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রাজধানীর আইসিটি টাওয়ারে ই-গভর্নমেন্ট মাস্টার প্ল্যান রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ডিজিটাল সেবার বিস্তৃতি ও উন্নতি ঘটিয়ে বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকবে। ই-গভর্ন্যান্সের জাতীয় ইনডেক্সে আমরা এখন ১১৫ নম্বরে আছি। আগামী পাঁচ বছরে আমরা আরও ৫০ ধাপ উন্নতি করে দুই অঙ্কের সংখ্যায় আসব, এমন লক্ষ্যমাত্রা আমাদের। ১০ বছর আগে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম। তখন অনেকেই বুঝতে পারেনি যে ডিজিটাল বাংলাদেশ কী? তবে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা তাদের ভুল প্রমাণ করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। আজ যা দেখছেন, তা ডিজিটাল বাংলাদেশের সামান্য কিছু। আরও অনেক কিছু আমরা করেছি এবং সামনে করব।’
তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের ভাষ্য, ‘বর্তমানে দেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের আয় ১০০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ এ আয় ৫০০ কোটি ডলারে উত্তীর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা প্রযুক্তির বিকেন্দ্রীকরণ করছি। এ জন্য দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। এখানে আমাদের সবার একটাই ইচ্ছা, তা হলো অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নে প্রযুক্তি ব্যবহার করা। আগামী ২০২১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে ডব্লিউসিআইটি। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এত বড় অর্জন সেখানে প্রদর্শন করা হবে। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীর বছরে এ আয়োজন দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবে। এতে ৮৩ দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।’
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসা ইতিমধ্যে সারা বিশ্ব থেকেই আসছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিসেস অ্যালায়েন্সের (উইটসা) মহাসচিব জেমস পয়জ্যান্টস বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ ভালো করছে এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই উইটসা ঢাকাকে বেছে নিয়েছে বিশ্ব সম্মেলন করার জন্য। বাংলাদেশের ভিশন ২০২১ রয়েছে, যার মাধ্যমে আইসিটিতে এগিয়ে চলেছে। যেকোনো দেশের সফলতার মূল বিষয় হলো নেতৃত্ব। বাংলাদেশের তা আছে।
এগিয়ে চলার হার স্পষ্ট
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। ২০১৪ সালে বিশ্বখ্যাত প্রথম সারির ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং ফার্ম এ টি কারনির গ্লোবাল সার্ভিস লোকেশন ইনডেক্স বা জিএসএলআইয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্থান পেয়েছিল। এ টি কারনির তালিকায় ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩২।
সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগের ফলে কয়েক বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে আইটিইউ অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, গার্টনার এবং এ টি কারনিসহ বেশ কিছু সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্টে আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে সঙ্গে নিয়ে ই-গভর্ন্যান্সসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। এর মাধ্যমে দেশি কোম্পানির জন্য স্থানীয় বাজার প্রসারিত হবে।
অগ্রগতির চিত্র
দেশে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা এক দশক থেকেই দৃশ্যমান। ইতিমধ্যে মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অন্য রকম উচ্চতায়। বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্বে অর্জন করে নিয়েছে নিজেদের একটি সম্মানজনক স্থান। সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের নাম হচ্ছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে অগ্রযাত্রা শুরু। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কয়েকটি অনুষঙ্গের ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করে চলেছে। সে অনুষঙ্গগুলো হলো: (ক) কানেকটিভিটি ও আইসিটি অবকাঠামো (খ) মানবসম্পদ উন্নয়ন (গ) আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন (ঘ) ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য। বিশেষজ্ঞরা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক এই উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আখ্যায়িত করছেন ডিজিটাল নবজাগরণ হিসেবে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ যেসব কাজ করছে: ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি পেশাজীবীর সংখ্যা ২০ লাখে উন্নীত করা, আইসিটি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় এবং জিডিপিতে এ খাতের অবদান ৫ শতাংশ নিশ্চিত করা।
জীবনমানে পরিবর্তন
দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে মানুষের জীবনে এর বড় প্রভাবও দেখা গেছে। বড় পরিবর্তন এনেছে উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায়। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেকের যাতায়াতে সুবিধাও হয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বাড়ায় নতুন উদ্যোক্তাও সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম কৃত্রিম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১
গত বছরের ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিট (স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ১৪ মিনিটে) কেপকেনাভেরালের জন কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে ফ্যালকন ৯ রকেটের পিঠে মহাকাশে যাত্রা শুরু করে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ । এরপর ৩৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিরক্ষরেখার ১১৯ দশমিক ৯ ডিগ্রিতে স্থাপিত হয় দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) বঙ্গবন্ধু-১। আর এর মধ্য দিয়েই অর্জনের তালিকায় এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি। স্যাটেলাইট মহাকাশে যাওয়ার পর পরীক্ষামূলকভাবে দেশে সম্প্রচার কার্যক্রম চালানো হয়। উৎক্ষেপণের ছয় মাসের মাথায় গত ৯ নভেম্বর বিকেল ৫টায় ফ্রান্সের থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস কোম্পানির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে স্যাটেলাইটটি বুঝিয়ে দওয়া হয়।
মেড ইন বাংলাদেশ
বিদেশ থেকে আমদানি কমিয়ে দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটনের হাইটেক ও মাইক্রোটেক ইন্ডাস্ট্রিজ পার্কে চালু হয় দেশের প্রথম কম্পিউটার উৎপাদন কারখানা। ডাক, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এই কারখানার উদ্বোধন করেন। এখানে উচ্চ মানসম্পন্ন ল্যাপটপ, ডেস্কটপ মনিটরসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্য তৈরি হয়। দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীসহ কারখানায় সব মিলিয়ে এখন প্রায় ১ হাজার কর্মী। প্রাথমিকভাবে প্রতি মাসে ৬০ হাজার ল্যাপটপ, ৩০ হাজার ডেস্কটপ এবং ৩০ হাজার মনিটর উৎপাদনের লক্ষ্য তাদের। শুরুতে বিনিয়োগ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ৩ লাখ বর্গফুটের বিশাল এই কারখানায় আয়োজন করা হয়েছে কম্পিউটার সংযোজন-উৎপাদনের এক মহাযজ্ঞ। ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের ডিজাইন ডেভেলপ, গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ, মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগ ও টেস্টিং ল্যাব নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এই কারখানা।
কারখানার জন্য যে যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে, তা জার্মান ও জাপান প্রযুক্তির। ইতিমধ্যেই এই কারখানায় তৈরি ল্যাপটপ ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ যুক্ত হয়ে আফ্রিকায় রপ্তানিও শুরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি দেশে মোবাইল সংযোজন কারখানা শুরু করেছে। শুরু হয়ে গেছে মেড ইন বাংলাদেশ কার্যক্রম।
সম্প্রতি এ নিয়ে ডিজিটাল ডিভাইস অ্যান্ড ইনোভেশন এক্সপোর আয়োজন করা হয়। সেখানে দেশে তৈরি রোবট ও স্টার্টআপগুলো তাদের উদ্ভাবন প্রদর্শন করে।
ফোর-জি ও ফাইভ-জি পরীক্ষা
টেলিযোগাযোগ খাতে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জনের মধ্যে একটি হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক (ফোর-জি) যুগে পা রাখা। নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে চার মোবাইল ফোন অপারেটরকে চতুর্থ প্রজন্মের (ফোরজি) টেলিযোগাযোগ সেবার লাইসেন্স হস্তান্তর করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। লাইসেন্স পাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে ফোর-জি নেটওয়ার্ক চালুর মাধ্যমে নিজেদের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে অপারেটরগুলো। আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় । দেশে ফাইভ-জি প্রযুক্তি উন্মুক্ত করার ঘোষণাও এসেছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন
অবকাঠামো উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ সারা দেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কানেকটিভিটি স্থাপনের জন্য বাংলাগভর্নেট ও ইনফো সরকার-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ফলে সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয়, ২২৭টি অধিদপ্তর, ৬৪টি জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং জেলা ও উপজেলার ১৮ হাজার ৫০০টি সরকারি অফিস নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। ৮০০টি সরকারি অফিসে ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম, ২৫৪টি অ্যাগ্রিকালচার ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন সেন্টার (এআইসিসি) ও ২৫টি টেলিমেডিসিন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা যাতে অফিসের বাইরে থেকেও দাপ্তরিক কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পাদন করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের মাঝে ২৫ হাজার ট্যাব বিতরণ করা হয়েছে।
নিজস্ব ডেটাসেন্টার
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের বিদ্যমান জাতীয় ডেটাসেন্টারটির সক্ষমতা বৃদ্ধি করে সেন্টারটির ওয়েবহোস্টিং ক্ষমতা ৭৫০ টেরাবাইটে উন্নীত করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য বিসিসির এলআইসিটি প্রকল্পের আওতায় একটি বিশেষায়িত ল্যাব এবং একটি স্পেশাল সাউন্ড ইফেক্ট ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়েছে।
হাইটেক পার্ক
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতের একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ শুরু করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ বোর্ডের ১২তম সভায় কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকা এবং মামলা জটিলতার কারণে কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক নির্মাণ এবং কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জনতা টাওয়ারে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক এবং জনতা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক ও খুলনায় শেখ হাসিনা হাইটেক পার্কে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিলেট ইলেকট্রনিক সিটি, রাজশাহীতে বরেন্দ্র সিলিকন সিটি, নাটোরে আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, চুয়েটে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর স্থাপন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলছে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন
মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল ভিত্তি এবং এই উন্নয়নে লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৪ হাজার এবং লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ৫৫ হাজার মানুষকে যথাক্রমে বেসিক আইসিটি, টপ-আপ, ফিউচার লিডার এবং ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিকেআইসিটি থেকে ৩ হাজার ২৭৬, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীন সাপোর্ট টু ডেভেলপমেন্ট অব কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক প্রকল্পের আওতায় দেশে-বিদেশে ৪ হাজার ৯৮১ এবং ‘বাড়ি বসে বড় লোক’ কর্মসূচির অধীনে ১৪ হাজার ৭৫০ জনকে বেসিক আইসিটি, স্কিল এনহ্যান্সমেন্ট ও ফ্রিল্যান্সিংসহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তথ্য ডিজিটাইজেশন
জনগণের দোরগোড়ায় তথ্য ও সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও সেবার ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৬০০ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। অ্যাপসগুলো গুগল প্লে স্টোরে রয়েছে। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে এসব মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে। এ ছাড়া ২০০ বছরেরও অধিককাল ধরে প্রচলিত বিচারিক কার্যক্রমের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ ও বিচার বিভাগ যৌথভাবে ‘বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনে সহায়তা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সাইবার হয়রানি রোধে একটি সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এই কর্মসূচির আওতায় একটি হেল্পলাইনও চালু করা হয়েছে।
স্টার্টআপ কালচার
দেশে ইতিমধ্যে পাঠাওয়ের মতো স্টার্টআপ চালু হয়েছে। স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড নামে সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন একটি সরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠার পর স্টার্টআপ মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সিড স্টেজে সর্বোচ্চ এক কোটি এবং গ্রোথ গাইডেড স্টার্টআপ রাউন্ডে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যাবে।
বাংলাদেশে একটি টেকসই স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরিতে সরকারি মালিকানায় প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি হিসেবে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড মুখ্য ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের কাজকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন আইডিয়া প্রকল্প বাংলাদেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের নির্দেশনায় ২০১৬ সাল থেকে কাজ করছে। ইতিমধ্যে শতাধিক স্টার্টআপ কোম্পানিকে অনুদান দেওয়া হয়েছে।
ই-গভর্ন্যান্স
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ তাদের দারিদ্র্য, প্রশাসনিক জটিলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মন্থর গতি প্রভৃতি দূর করার জন্য আইসিটি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। আইসিটি সম্প্রসারণ ও ব্যবহার জনসাধারণের নাগালের মধ্যে আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে আইসিটির সফল ব্যবহার ও প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, অধিকতর উন্নত জনসেবা প্রদানের জন্য প্রশাসনের সর্বস্তরে ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা করেছে।
ফেসবুক ও ফ্রিল্যান্সিং
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী ৬ কোটির বেশি। গড়ে উঠেছে এফ-কমার্স বা ফেসবুক-ভিত্তিক ব্যবসা। এর বাইরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সার। দেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছেন সফটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তারা। এ খাতে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় আসছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আরেক বড় অগ্রগতি হয়েছে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করার বিষয়টি । এ ছাড়া ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাত দেশে প্রসারিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, গত এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দেশে সফটওয়্যার খাতের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা বেসিসে সদস্য কোম্পানি রয়েছে ১ হাজার ২০০টি। এর মধ্যে ৬০টি কোম্পানিতে শেয়ার ও কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা। দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্যতম একটি খাত বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও। খাতটিতে কাজ করছেন অন্তত ৩৫ হাজার তরুণ-তরুণী।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে বাংলাদেশের তরুণদের এগিয়ে থাকতে এআই, মেশিন লার্নিং, বিগ ডেটার মতো আধুনিক বিষয়গুলো শেখার দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের সম্পদ তরুণ জনশক্তি। তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হলে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এ খাতে দেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও এখন রয়েছে। ফ্রিল্যান্সারদের দীর্ঘদিনের দাবি বিদেশ থেকে অর্থ আনার ক্ষেত্রে পেপ্যাল চালু করা করা। এ খাতে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর বাইরে কম খরচে দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়ার দাবিও রয়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম কমলেও গ্রাহক পর্যায়ে তার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি দেশে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল ডিভাইস অ্যান্ড এক্সপো অনুষ্ঠানের সমাপনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আইসিটিতে যে সফলতা আমরা দেখছি, তা ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।’