দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রধান উৎস হচ্ছে রাজস্ব আয়। আর এই রাজস্ব আয়ের একটি অংশ আসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট থেকে। রাজস্ব আয় আদায়ের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির প্রয়োগে দেশি সফটওয়্যার ব্যবহারের আদেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কয়েকটি সফটওয়্যারকে অনুমোদনও দিয়েছে। ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার নিয়ে বলেছেন ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেডের চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফারহানা এ রহমান।
ডিজিটাল হওয়ার পথে
১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন অনুযায়ী, সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে কাগজে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে হতো। কিন্তু এখন আদেশানুক্রমে সব প্রতিষ্ঠানকে মাসিক ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে হয় অনলাইনে। তাই নতুন এ ব্যবস্থায় ঝামেলামুক্তভাবে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে হলে ভ্যাট নিবন্ধিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যাট অটোমেশন সফটওয়্যার ব্যবহারের বিকল্প নেই বলে জানালেন ফারহানা এ রহমান।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে সরকার ও এনবিআর কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় ও ইন্টিগ্রেটেড ভ্যাট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সিস্টেম বসানোর উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগের ফল হিসেবে সরকার ভ্যাট সংগ্রহ এবং ভ্যাট–সংক্রান্ত হিসাব ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশে তৈরি সফটওয়্যারকে এনবিআরের তালিকাভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করে।
এই ঘোষণার পর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন রকম সংশয় ও ভীতি কাজ করতে থাকে। কারণ, কর ও ভ্যাটবিষয়ক জ্ঞানের অভাবে এটাকে ভয় পাওয়া, সর্বোপরি রাজস্ব দেওয়ার অনীহা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠান একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকলে (ইআরপি বা হিসাব ব্যবস্থাপনা) সে ক্ষেত্রে পুরো ইআরপির ব্যবহার বন্ধ না করে বর্তমান ইআরপি সিস্টেম থেকে এপিআই তৈরি করে ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারের সঙ্গে যুক্ত (ইন্টিগ্রেট) করে নিতে পারে।
ফারহানা এ রহমান বলেন, যাঁরা এখনো সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন না, তাঁদের অবশ্যই তালিকাভুক্ত সফটওয়্যারগুলো থেকে প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত ভ্যাট সিস্টেম চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
কীভাবে কাজ করে
এনবিআরের তালিকাভুক্ত সফটওয়্যারগুলো এনবিআর নির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে তৈরি করা হয়েছে। সফটওয়্যারে মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা, প্রজ্ঞাপন ও আদেশ পালনে সক্ষমতা সম্পন্ন করতে পারার ব্যবস্থা থাকে। সফটওয়্যারে ক্রয় হিসাব রেজিস্টার ও বিক্রয় চালানপত্রে কোনো তথ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিক্রয় হিসাব, চলতি হিসাব রেজিস্টার এবং দাখিলপত্র হালনাগাদ হয়ে যায়। সফটওয়্যারে আদর্শ হার বা ট্যারিফ মূল্য বা সংকুচিত ভিত্তি মূল্যে সরবরাহ করার সুবিধা সৃষ্টিসহ উৎসে মূসক আদায়/ কর্তন, অপচয় ও উপজাত পণ্য ব্যবস্থাপনা, ডেবিট নোট ও ক্রেডিট নোটের ব্যবস্থাপনা, চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন, উপকরণ কর রেয়াত ব্যবস্থাপনা ও মূল্য ঘোষণা ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করার সুবিধা থাকে।
মূল্য ঘোষণায় বর্ণিত সহগের ভিত্তিতে উৎপাদিত পণ্য, ব্যবহৃত উপকরণ ও বিক্রির বিপরীতে প্রকৃত উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্যের একটি তুলনামূলক প্রতিবেদন প্রতি কর মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়। যাতে মূল্য ঘোষণায় বর্ণিত সহগে কোনো অসংগতি থাকলে তা তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। মাসিক দাখিলপত্রসহ অন্যান্য রেজিস্টার (ডেবিট হিসাব, ক্রেডিট হিসাব, চলতি হিসাব) এবং রিপোর্ট অটোমেটেড সিস্টেম থেকে প্রস্তুত ও প্রিন্ট করার সুবিধা আছে সফটওয়্যারে। সফটওয়্যারে শুধু একবার মূল মূসক চালানপত্র প্রিন্ট করা যায়। মূসক চালানপত্রে সময় ও তারিখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্ট করা, যা কেবল যখনই প্রিন্ট করা হবে, সেই সময় ও তারিখ অনুযায়ী প্রদর্শন করবে।
ফারহানা এ রহমান বললেন, ‘প্রতিদিনের কার্যক্রম শেষে সেই দিনের কম্পিউটার থেকে তৈরি প্রতিবেদন ও বিধি মোতাবেক হিসাবরক্ষণ–সংক্রান্ত সব বাণিজ্যিক দলিলা প্রিন্ট করা যাবে।’ এনবিআর–সংশ্লিষ্ট মূসক কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সফটওয়্যারে প্রবেশ সুবিধা থাকে। এ রকম যত নির্দেশনা রয়েছে এনবিআরের, তার সব মেনেই ভ্যাট ব্যবস্থাপনার সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। প্রতিদিনের কার্যক্রম শেষে সব তথ্যের ন্যূনতম দুইটি ব্যাকআপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই সফটওয়্যারে হ্যাকিং বা টেম্পারিংসহ সব ধরনের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারের কাজ
মূসক আইন ১৯৯১ অনুযায়ী, এনবিআর নিবন্ধিত সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নির্মিত সফটওয়্যার বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দেয়। আর প্রতিষ্ঠানগুলো সে অনুযায়ী তা করে। মাসিক রিটার্ন নির্ভুলভাবে প্রণয়ন করতে হলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুরো মাসের ক্রয়, বিক্রয়, উপকরণ-উদপাদ অনুপাত,পণ্য স্থানান্তর, উৎসে ভ্যাট কর্তন এবং এনবিআর নির্ধারিত সব নিয়মকানুন অনুসরণ করে এবং অন্যান্য বিষয় সমন্বয় করার কাজটিও সঠিক ও নির্ভুলভাবে হিসাব করতে হবে। হাতে–কলমে বা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এ কাজগুলো নির্ভুলভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব।
ইউওয়াই সিস্টেমসের সফটওয়্যার
ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেড ভ্যাট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ইউওয়াইভিএমএস সফটওয়্যারটি এনবিআরের তালিকাভুক্ত। ফারহানা এ রহমান জানান, এ সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ অনেক স্পর্শকাতর ভুল চিহ্নিত হয়েছে এবং তা সংশোধেনের ফলে তাদের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। ইউওয়াইভিএমএস সফটওয়্যারটি বর্তমানে মূসক আইন ১৯৯১ অনুযায়ী কাজ করে, কিন্তু এই সফটওয়্যারে মূসক আইন ২০১২ অনুযায়ী মাসিক রিটার্ন প্রণয়ন অথবা এনবিআর নির্ধারিত নতুন নিয়ম সমন্বয় করার কাজটিও সহজে করা যাবে। বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠান ইআরপি, অ্যাকাউন্ট ম্যানজেমন্ট, এসএপির মতো কোনো পূর্ণাঙ্গ ইআরপি সিস্টেম ব্যবহার করে থাকলে তা থেকে এপিআই তৈরি করে এই ভ্যাট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারের সঙ্গে মেলানো যাবে। ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেডের ভ্যাট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার সাত বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে।