উদ্ভাবন নাকি অনুকরণের পথে ফেসবুক?
মস্তিষ্কের ভাবনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাইপ করা যাবে। চার বছর আগে ফেসবুক যখন নতুন এ উদ্যোগের কথা জানাল, তখন সবার কাছে তা অদ্ভুত ঠেকেছিল। নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে ‘বিল্ডিং ৮’ নামের একটি হার্ডওয়্যার বিভাগ চালু করেছিল ফেসবুক। এ বিভাগে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। বিভাগটি দেখভালের দায়িত্ব পান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সির (ডারপা) অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক নির্বাহী কর্মকর্তা। ঘোষণা দেওয়া হয়, ফেসবুক নতুন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে, যার মাধ্যমে মস্তিষ্ক ব্যবহার করে টাইপ করা যাবে এবং ত্বকের মাধ্যমে শোনা যাবে। কিন্তু ফেসবুকের সেই উদ্ভাবন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এর পরিবর্তে অন্য প্রতিষ্ঠানের ফিচার নকলের ফাঁদে আটকে গেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এ তথ্য।
সিএনএন বলছে, ফেসবুক যে অদ্ভুত কিন্তু সাহসী ধারণা নিয়ে কাজ শুরুর কথা বলেছিল, তা বাস্তবে আনা সম্ভব হবে কি না, এটি পরিষ্কার করেনি। ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য হার্ডওয়্যার খাতে উদ্ভাবনের প্রচেষ্টাটি পৃথক এক ধারণা ছিল। এ ধারণা অবশ্য ফেসবুকের অনন্য নয়। এ ধরনের অদ্ভুত ধারণার প্রকল্প নিয়ে অনেক আগে থেকেই কাজ করছে গুগল। এগুলো গুগলের ‘মুনশট’ প্রকল্প হিসেবে বেশি পরিচিত। ফেসবুকও গুগলের অনুকরণে এ ধরনের প্রকল্পের পথে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা খায় ফেসবুকের প্রকল্প। কয়েক মাসের মধ্যেই ডারপার নির্বাহী ফেসবুকের প্রকল্প ছেড়ে দেন। পরে ‘বিল্ডিং ৮’ বিভাগের নাম পরিবর্তন করে পোর্টাল রাখা হয়। পোর্টাল থেকে আমাজনের স্মার্ট স্পিকারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পোর্টাল স্মার্ট স্পিকার বাজারে ছাড়ে ফেসবুক।
চার বছর ধরেই ফেসবুক বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান, বৃহত্তম এবং সর্বাধিক পরিচিত প্রযুক্তি সংস্থা হিসেবে রয়ে গেছে। গুগলের সঙ্গে অনলাইন বিজ্ঞাপনের বাজারেও আধিপত্য ধরে রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নিজস্ব উদ্ভাবনী ফিচার ও পণ্য তৈরির পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পণ্যের জনপ্রিয় ফিচার নকল করার জন্য বেশি শিরোনামে আসতে হয়েছে ফেসবুককে। মস্তিষ্কপ্রযুক্তি বা অন্য কোনো অনন্য হার্ডওয়্যার ডিভাইস তৈরির পরিবর্তে ফেসবুকের পক্ষ থেকে ইউটিউব, টুইচ, টিকটক, লিংকডইন, পিন্টারেস্ট ও স্ল্যাকের মতো সেবার নকল তৈরির অভিযোগ রয়েছে। এ তালিকা গত কয়েক বছরে দীর্ঘ হয়েছে। শুধু জনপ্রিয় সেবাগুলোর অনুকরণ নয়, এর বাইরে ফেসবুক জনপ্রিয় ডেটিং অ্যাপ, চাকরির পোর্টাল ও প্রতিদ্বন্দ্বী স্ন্যাপচ্যাটের জনপ্রিয় ফিচার স্টোরিজও নকল করে চালু করেছে। সম্প্রতি গুঞ্জন উঠেছে, অডিও বাজারের দিকেও নজর দিচ্ছে ফেসবুক। তারা ক্লাবহাউস নামের অডিও অ্যাপের নকল করতে যাচ্ছে।
ফেসবুকের বিরুদ্ধে আরেক অভিযোগ হচ্ছে, যখন প্রতিষ্ঠানটি ফিচার নকল করেও প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে পারে না, তখন তাকে কিনে নেয়। ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রামকে কিনে নেয় ফেসবুক। এরপর ফেসবুকের হস্তগত হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ ও অকুলাস। অবশ্য ফেসবুকের এই আগ্রাসী অধিগ্রহণের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের নজর এড়ায়নি। নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিটিয়া জেমসের ভাষ্য, ফেসবুকের বিরুদ্ধে আধিপত্য এবং একচেটিয়া শক্তি খাটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া ছোট প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমিয়ে রাখতে ও প্রতিযোগিতার বাইরে ছিটকে দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
ফেসবুকের ধারাবাহিক এবং প্রকাশ্য নকলের প্রচেষ্টা ঘিরে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনের ক্ষমতা সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনকে চালিকা শক্তি মনে করা হয়। তবে অভিযুক্ত ফেসবুক একা নয়; প্রতিটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধেই কিছুটা নকলের অভিযোগ রয়েছে। যেমন ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটককে অনুকরণ করার তালিকায় স্ন্যাপচ্যাট, এমনকি ইউটিউবের নামও রয়েছে। তবে সবাইকে ছাড়িয়েছে ফেসবুক। তারা এতটাই অনুকরণ করেছে যে সর্বশেষ সত্যিকারের নিজস্ব উদ্ভাবনী পণ্য কবে এনেছে, তা এখন মনে করা দুষ্কর।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক টাকার মেরিয়ন অবশ্য বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনুকরণ করা বা অধিগ্রহণ করা খারাপ কোনো কৌশল নয়। তবে এর পাশাপাশি নিজস্ব মূল ধারণা নিয়েও কাজ করা দরকার। যদি তা না করা হয়, তবে নিজেকে টিকিয়ে রাখা কঠিন।
অন্য প্রতিষ্ঠানের ফিচার অনুকরণ নিয়ে ফেসবুকের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
সত্যি বলতে কি, উদ্ভাবন কঠিন এবং অদ্ভুত ধারণাগুলো নিয়ে কাজ করা আরও কঠিন। গুগল এ ধরনের অদ্ভুত প্রকল্প বাস্তবায়নের পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে। তাদের এ রকম প্রকল্পের মধ্যে ছিল ইন্টারনেট বেলুন, স্বচালিত গাড়ি প্রভৃতি। তবে যেসব অদ্ভুত প্রকল্প সফল হয় না, গুগল তা বন্ধ করে দেয়। ফেসবুকে ২০০৬ সালে নিউজ ফিড চালুর পর থেকে নানা পরিবর্তন এসেছে। মানুষ অনলাইনে কীভাবে তথ্য গ্রহণ করবে, তার ধারণা বদলে দিয়েছে ফেসবুক। তারা এরপর থেকে ফোন, সৌরচালিত ডেলিভারি ড্রোনের মতো নানা প্রকল্প চালুর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনোটিই সফল হয়নি। ফেসবুকের ক্রিপ্টোকারেন্সি–প্রচেষ্টা নিয়েও সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
নিজেদের উদ্ভাবনী প্রকল্প ব্যর্থ হলেও প্রতিদ্বন্দ্বীকে নকল করে চালু করা বেশ কিছু ফিচার ফেসবুকের জন্য দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। এর মধ্যে ইনস্টাগ্রামের স্টোরিজ অন্যতম। এটি স্ন্যাপচ্যাটের নকল। ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসও এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটিও প্রচলিত ই-কমার্সের অনুকরণে তৈরি। গত বুধবার নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, অডিও চ্যাটিং পণ্য তৈরি করতে যাচ্ছে ফেসবুক। এটি অনেকটাই ক্লাবহাউসের অনুকরণ। ফেসবুকের মুখপাত্র জো অসবর্ন বলেন, তাঁদের কোম্পানি সব সময় অডিও–ভিডিওর ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ খুঁজছে। নতুন ধারণার ক্রমাগত উন্নতি ও গ্রহণ সিলিকন ভ্যালির বৈশিষ্ট্য। এর ফলে গ্রাহকদের মধ্যে আরও বিকল্প গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। তাই ফেসবুক কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্ভাবকের বদলে সংস্কারকের ভূমিকা নেয়।
ইনস্টাগ্রামের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কেভিন সিসট্রোমকে অনুকরণ করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বে প্রথম গাড়ি তৈরির কথাটি ভাবুন। কেউ একজন গাড়িটি উদ্ভাবন করে। তবে অন্য কোনো কোম্পানি যদি নানা সুবিধাযুক্ত করে নতুন গাড়ি তৈরি করে, তাকে কি দোষ দেওয়া যায়? প্রশ্ন হচ্ছে, গাড়ির ওপরে আপনি কতটা অনন্য সুবিধা যুক্ত করতে পারছেন সেটি।’
সিলিকন ভ্যালির বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কেভিনের কথাটি অবশ্য সত্য। কে প্রথম ধারণাটি তৈরি করেন, তা নিয়ে মাথা ঘামান না গ্রাহকেরা। কে ধারণাটি সবচেয়ে ভালো বাস্তবায়ন করেছে, তারা তা দেখেন। যেমন, অ্যাপল স্মার্টফোন উদ্ভাবন করেনি। তবে তারা একসময় সেরা আইফোন তৈরি করেছিল। এ কারণেই স্ন্যাপচ্যাটের তুলনায় ইনস্টাগ্রাম স্টোরিজ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায়।
ফিরে আসা যাক ফেসবুক মস্তিষ্কের ভাবনা টাইপপ্রযুক্তির কথায়। ফেসবুকের এ ধারণাও একেবারে অনন্য ছিল না। ফেসবুকের আগেই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক মস্তিষ্কে কম্পিউটারের পরিকল্পনার ধারণা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া অন্যান্য ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তি নিয়ে কয়েক দশক ধরেই কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ভবিষ্যতে ফেসবুকে হয়তো মস্তিষ্ক পড়তে পারে—এমন যন্ত্র নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু ফেসবুকের সে যন্ত্র বাজারে আসার আগেই একই রকম যন্ত্র বাজারে চলে আসতে পারে।