গরিবের ভাগ্য ফেরাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা!

১৮ বছরের তরুণী সানজানা বাবার চিকিৎসার জন্য স্কুলে পড়া বাদ দেন। এখন সানজানাও কার্জ অ্যাপের মাধ্যমে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করছেটাইম

মুঠোফোনের ব্যবহার নিয়ে অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন। গ্রামে কিংবা নদীর পারে ঘুরতে গেলেন, আর গিয়ে দেখলেন এক দল কিশোর হয়তো টিকটকের জন্য ভিডিও করছে। তাদের কাজ দেখে আপনি হয়তো মহাবিরক্ত। ভারতের কর্ণাটকের ছিলুকাভেদী ও এলাহাল্লি গ্রামে গেলে মুঠোফোন সামনে নিয়ে অডিও রেকর্ড করতে দেখা যাবে। তবে সেই অডিও রেকর্ডিং বিনোদনের জন্য নয়, কয়েকটি গ্রামের মানুষ কাজ করছেন হালের জনপ্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির সফটওয়্যার চ্যাটজিপিটির জন্য। কী হচ্ছে সেই সব গ্রামে, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে টাইম ম্যাগাজিন।

নৈতিকতানির্ভর ডেটা প্রতিষ্ঠান

ভারতের কর্ণাটকের ছিলুকাভেদী ও এলাহাল্লি গ্রামের মানুষেরা এখন মুঠোফোন অ্যাপের মাধ্যমে অডিও রেকর্ড করে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিচ্ছে। গ্রামের ৩০ বছরের নারী চন্দ্রিকা মুঠোফোনের মাধ্যমে নিয়মিত ভয়েস রেকর্ড করেন। একই গ্রামের ১৮ বছরের তরুণী সানজানা বাবার চিকিৎসার জন্য স্কুলে পড়া বাদ দেন। সানজানাও অ্যাপের মাধ্যমে ভয়েস রেকর্ড করেন। গ্রামের ২১ বছরের তরুণ কানাকারাজ এস কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি পড়াশোনার খরচ জোগাতে আগে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। এখন মুঠোফোনে কথা ধারণ বা ভয়েস রেকর্ড করে অর্থ আয় করছেন। পুরো বিষয়টিকে অনেকেই নেটফ্লিক্সের জামতারা সিরিজের জামতারা গ্রামের গল্প বলে ভাবছেন না তো? যেখানে দেখা যায়, কিশোরেরা মুঠোফোনে কণ্ঠ নকল করে ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড নিয়ে গ্রাহকদের প্রতারিত করে।

টাইমের প্রচ্ছদে কার্জ নিয়ে প্রতিবেদন
টাইম

কর্ণাটকের দুই এলাকার ২২ বছর বয়সী সন্তোষ, ২৩ বছর বয়সী গুরুপ্রসাদও ডেটাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তাঁদের নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে টাইম ম্যাগাজিন। ভিন্ন পথে কাজ করছেন ভারতের তরুণ মনু চোপড়া। গ্রামের তরুণ-যুবাদের নিয়ে মুঠোফোন ও অ্যাপ দিয়েই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন তিনি। মুঠোফোনের মাধ্যমে এই কর্মীদের পুরো কাজটিকে টাইম ম্যাগাজিন ‘দারিদ্র্য বিমোচনে চ্যাটজিপিটি’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। পুরো কাজটি করছে মনু চোপড়া প্রতিষ্ঠিত কার্জ নামে একটি অলাভজনক ডেটা প্রতিষ্ঠান। এটি ২০২১ সালে ভারতে বেঙ্গালুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কোম্পানি নিজেদের বিশ্বের প্রথম নৈতিকতানির্ভর ডেটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করে।

দারিদ্র্য বিমোচনে চ্যাটজিপিটি

কার্জ সংগ্রহ করা ডেটা বা তথ্য–উপাত্ত বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে বাজারমূল্যে বিক্রি করে। পরিচালন ব্যয় বাদে পুরো অর্থ অংশগ্রহণকারী কর্মীকে প্রদান করা হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ ঐতিহাসিকভাবে ভারতে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ঘণ্টাপ্রতি ন্যূনতম পাঁচ ডলার মজুরিতে কাজের সুযোগ আছে।
কার্জ প্রযুক্তি দুনিয়ায় অন্য রকম একটি বিষয় চালুর চেষ্টা করছে। ডেটাকর্মী হিসেবে যিনি কাজ করছেন, তাঁর ডেটা পরবর্তী সময়ে যতবার বিক্রি হবে, ততবার তিনি লভ্যাংশ পাবেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনু চোপড়ার বয়স ২৭ বছর। তিনি জানান, এখনকার বাজারের মজুরি প্রথার কারণেই পুরো বাজার ধসে পড়ে। আমরা অলাভজনকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি, আমরা বাজারের ব্যর্থতা বাজারে বসে সমাধান করতে পারব না। যারা সমাজে সংখ্যালঘু, তাদের ভাষাকে অনলাইন দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এই অ্যাপের মাধ্যম কন্নড় ভাষার নানান প্রকৃতি সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অ্যাপের মাধ্যমে দেড় হাজার ডলার পর্যন্ত আয় করা যায়। প্রতিষ্ঠানটি এযাবৎ মজুরি হিসেবে আট লাখ ডলার বা সাড়ে ছয় কোটি রুপি প্রদান করেছে। মনু চোপড়ার ভাষ্য, ‘আমি বিশ্বাস করি, এভাবে দ্রুত কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।’

কার্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনু চোপড়া
টাইম

যা করছে কার্জ

মনু চোপড়া জানান, ‘আমরা এমন একটি মডেল নিয়ে কাজ করছি, যেখানে যেসব সম্প্রদায় পিছিয়ে আছে, তাদের সম্পদ বিকাশের চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ নিজের অবস্থান থেকে কার্জের জন্য কাজ করছে। এখন প্রতিষ্ঠানটি ভিন্নভিন্ন কন্নড় উপভাষায় অডিও রেকর্ড সংগ্রহ করছে। একটি এআই স্পিচ (কৃত্রিম কণ্ঠস্বর) মডেলকে প্রশিক্ষিত করতে চেষ্টা করছে। যক্ষ্মা সম্পর্কে নানান প্রশ্নের উত্তরনির্ভর এআই মডেল তৈরিতে এই অডিওগুলো কাজ করছে।’

শুধু যক্ষ্মা–সচেতনতার এআই মডেলই নয়, অডিও রেকর্ডগুলো কন্নড় ডেটাসেট হিসেবে হিসেবে বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। যতবার বিক্রি হচ্ছে, ততবার ডেটাকর্মীরা লভ্যাংশ পাচ্ছেন। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি মাইক্রোসফট, এমআইটি আর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে। গত ফেব্রুয়ারিতে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও পাঁচটি ভাষায় কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মারাঠি, তেলেগু, হিন্দি, বাংলা ও মালয়ালম ভাষার চ্যাটবট তৈরির জন্য অডিও সংগ্রহ করছে কার্জ। এসব ভাষার নানান উপভাষাকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য, কৃষি, স্যানিটেশন, ব্যাংকিংসহ নানা বিষয়ে চ্যাটবট কাজ করছে।

ক্ষুদ্র বনাম বড় ভাষার অবস্থান

এআই দুনিয়ায় লেখা বা কথার দাম অনেক। নানা ধরনের লেখা ও কথা মানে আপনার কণ্ঠস্বর থেকেই এআই নানান মাত্রায় কাজ করে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা এখন এআই দুনিয়াতে সোনার মতো দুর্লভ আকরিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। অনলাইনে যে ভাষার যত তথ্য, সেই ভাষার মানুষের জন্য এআইভিত্তিক নানা প্রযুক্তির বিস্তৃতি ঘটছে দ্রুতগতিতে। এই যেমন চ্যাটজিপিটির মতো ‘ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ ইংরেজি ভাষায় খুবই কার্যকর। উইকিপিডিয়ায় ইংরেজিতে লেখা ৬০ লাখ নিবন্ধ আছে। আরও তো লাখ লাখ ওয়েবসাইট আছেই। এসব মিলিয়ে ইংরেজি বা অন্যান্য বড় ভাষার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নানা প্রযুক্তিতে দেখা যায় সক্রিয়ভাবে।

অন্যদিকে অনলাইনে ক্ষুদ্র ভাষার অবস্থান এ ক্ষেত্রে বেশ দুর্বল। যেমন ভারতের কন্নড় ভাষা বা কানাড়ি ভাষা কর্ণাটকের সরকারি ভাষা। মাত্র ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। আর উইকিপিডিয়ায় ৩০ হাজারের মতো নিবন্ধ আছে কন্নড় ভাষায়। ইংরেজি বা শক্তিশালী ভাষাগুলো এআই দুনিয়ায় দ্রুত এগিয়ে যাবে স্বাভাবিক। উল্টো দিকে ক্ষুদ্র ভাষা যেগুলো, তারা কি পিছিয়ে থাকবে? এমনিতেই প্রযুক্তি সামাজিক বৈষম্য বাড়ায় বলে অভিযোগ আছে, সেখানে এআই কি আরও বৈষম্য বাড়াবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতের কর্ণাটকে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে এআই দুনিয়াতে কাজ করছে একটি স্টার্টআপ। মাইক্রোসফট রিসার্চের প্রধান গবেষক ও ভাষাবিদ কালিকা বালি জানান, ‘আমি মনে করি, ভাষা প্রযুক্তি দুনিয়াতে বাধা হতে পারে না। যে যেই ভাষায় কথা বলুক না কেন, প্রযুক্তি সবাই ব্যবহার করবে।’

বস্তি থেকে স্ট্যানফোর্ড যাওয়ার গল্প

মনু চোপড়া নিজে দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন। বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে আবারও ভারতে ফিরে দারুণ কিছু করার চেষ্টা করছেন। ১৯৯৬ সালে ভারতের দিল্লির এক বস্তিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চোপড়া। তাঁর দাদা পাকিস্তান থেকে ভারতভাগের সময় ১৯৪৭ সালে দিল্লিতে আসেন। চোপড়ার মা–বাবা শিক্ষিত ছিলেন। তারপরও পাতে খাবার জোগাড় করতে অনেক কষ্ট করতে হতো। সেই পরিবেশে ম্যাগি নুডলস ছিল সবচেয়ে দামি খাবার।
বর্ষার পানিতে সেই বস্তি বন্যায় প্লাবিত হতো। বস্তির একটি এনজিও স্কুলে পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। নবম শ্রেণিতে বৃত্তি নিয়ে দিল্লির একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হন মনু চোপড়া। স্কুলে সামাজিকভাবে কম হেয় হননি তিনি। ১৭ বছর বয়সে কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। দিল্লিতে নির্ভয়া নামের নারী ধর্ষণের শিকারের ঘটনায় চোপড়া সহিংসতা প্রতিরোধী একটি ঘড়ির মডেল তৈরি করেছিলেন। সেই যন্ত্র ব্যবহারকারী হৃদ্‌যন্ত্রের গতি বুঝে আক্রমণকারীকে বৈদ্যুতিক ধাক্কা দিতে পারত। সেই যন্ত্র ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের নজরে আসে। তাঁর উৎসাহেই চোপড়া স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। পড়াশোনা শেষ করে ভারতে এসে মাইক্রোসফট রিসার্চে যোগ দেন চোপড়া। সহকর্মী বিবেক শেষাদ্রির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ২০২১ সালে কার্জ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা সাফিয়া হুসেইন।

আগামীর বাজার

ভারত বহু বছর ধরেই প্রযুক্তি দুনিয়ায় প্রভাব রাখছে। একসময়ের কলসেন্টার কিংবা শ্রমনির্ভর ভারত, ধীরে ধীরে বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রকৌশল মাধ্যমে প্রযুক্তি দুনিয়ায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এআইনির্ভর ডেটার দুনিয়াতে ভারতের নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগ বা স্টার্টআপ নিজেদের উপস্থিতি তৈরি করেছে।

২০২২ সালে এআইনির্ভর ডেটা দুনিয়ার বাজারের আকার ছিল ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, ২০৩০ সালে তা হবে ১ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। টাকার মূল্যে বিশাল বাজার হলেও এই টাকা ভারত, কেনিয়া বা ফিলিপাইনের ডেটাকর্মী যাঁরা, তাঁদের কাছে সামান্য অংশই পৌঁছাবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক জোনাস ভ্যালেন্টে জানান, বৈষম্যের কারণে কর্মীদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ কম। এআই পুরো সমাজব্যবস্থার ওপরে প্রভাব রাখবে, অথচ যাঁরা এই খাতে কাজ করছেন, তাঁদের সুযোগ কম থাকছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কাজ করছে কার্জ।
টাইম অবলম্বনে