ভৌতিক কণার খোঁজে চীনা টেলিস্কোপ
ভৌতিক কণা খুঁজতে বিশ্বের বৃহত্তম আন্ডারওয়াটার টেলিস্কোপ তৈরি করছে চীন। চীনের বিজ্ঞানীরা তৈরি করছেন ট্রপিক্যাল ডিপ-সি নিউট্রিনো টেলিস্কোপ। সংক্ষেপে ট্রাইডেন্ট নামে ডাকা হচ্ছে পানির নিচের এই টেলিস্কোপকে। সমুদ্রতলের নিচে থেকে আলোর ক্ষণিকের ঝলকানি পরীক্ষার মাধ্যমে মহাজাগতিক রশ্মির উত্স অনুসন্ধান করবে টেলিস্কোপটি।
চীনের নতুন নিউট্রিনো শনাক্তকারী এই যন্ত্র সমুদ্রপৃষ্ঠের সাড়ে ১১ হাজার ফুট নিচে অবস্থান করবে। চীনা ভাষায় এই টেলিস্কোপের নাম দেওয়া হয়েছে হাই লিং, যার বাংলা অর্থ সমুদ্রের ঘণ্টা। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রতটে নোঙর করা থাকবে টেলিস্কোপটি। ২০৩০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে এই টেলিস্কোপ। অধরা সব কণার খোঁজে সমুদ্রের গভীর থেকে কাজ করবেন বিজ্ঞানীরা।
প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০ হাজার কোটি গোস্ট পার্টিকল বা ভৌতিক কণা আমাদের শরীরের প্রতিটি বর্গসেন্টিমিটারের মধ্য দিয়ে চলে যায়। এই কণাকে পদার্থবিজ্ঞানীরা ভূতের কণা হিসেবে নিউট্রিনো বলে অভিহিত করেন। নিউট্রিনোর থাকে অস্তিত্বহীন বৈদ্যুতিক চার্জ। প্রায় শূন্য ভর হওয়ায় অন্যান্য ধরনের পদার্থের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ বা যোগাযোগ নেই।
নিউট্রিনোর গতি কমিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা কিছু কণার উৎপত্তি খুঁজে পেতে পারেন বলে মনে করেন। গতি কমানোর মাধ্যমে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের প্রাচীন নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ ও গ্যালাকটিক সংঘর্ষে সৃষ্ট কণার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
চীনা টেলিস্কোপ প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী জু ডংলিয়ান বলেন, ‘পৃথিবীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ট্রাইডেন্ট আমাদের গ্রহের বিপরীত দিক থেকে আসা নিউট্রিনো শনাক্ত করবে। ট্রাইডেন্টকে বিষুবরেখার কাছাকাছি বসানো হচ্ছে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে সব দিক থেকে আসা নিউট্রিনোর খোঁজ নিতে পারবে এই টেলিস্কোপ। এককথায় পুরো আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম এই টেলিস্কোপ।’
পদার্থবিজ্ঞানীদের ভাষ্যে নিউট্রিনো সর্বত্র আছে। ফোটনের পর মহাবিশ্বের সর্বাধিক সাবঅ্যাটোমিক বা উপপরমাণু কণা হিসেবে নিউট্রিনোর অবস্থান। তারার পারমাণবিক অবস্থা থেকে শুরু করে বিশাল সুপারনোভা বিস্ফোরণ, মহাজাগতিক রশ্মি ও নানান তেজস্ক্রিয় পরিস্থিতি থেকে এই কণার খোঁজ পাওয়া যায়। নিউট্রিনো সব জায়গায় পাওয়া গেলেও অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে ন্যূনতম মিথস্ক্রিয়া নেই। যে কারণে নিউট্রিনো শনাক্ত করা অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন একটা কাজ। প্রথম ১৯৫৬ সালে একটি পারমাণবিক চুল্লি থেকে এদের খোঁজ মেলে। অনেক নিউট্রিনো শনাক্তকরণ পরীক্ষায় সূর্য থেকে আমাদের কাছে আসা কণার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেছে। নতুন টেলিস্কোপটি বিরল নিউট্রিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তথ্য দেবে নানান মহাজাগতিক রশ্মি থেকে। রহস্যময় উৎস থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আঘাত করছে নিউট্রিনোগুলো। ট্রাইডেন্ট নিউট্রিনো টেলিস্কোপের কর্মক্ষমতার সীমাকে বাড়িয়ে দেবে। অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল নিউট্রিনোর উৎসের জন্য এখন প্রায় পুরো আকাশে চোখ রাখতে পারব আমরা। নিউট্রিনো আমাদের গ্রহের উপর দিয়ে বেশির ভাগ পদার্থের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণরূপে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে পানির অণুর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় নিউট্রিনোর। নিউট্রিনো পানি বা বরফের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার সময়, কখনো কখনো মিউন নামক কণা উপজাত হিসেবে তৈরি করে। এতে আলোর ঝলক তৈরি হয়। আলোক ফ্ল্যাশ গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর শক্তি ও উৎস নিয়ে নানান তথ্যের খোঁজ করবেন।
নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে টেলিস্কোপের নানান বিষয় নিয়ে একটি গবেষণাপত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে৷ ট্রাইডেন্ট বেশি সংবেদনশীল ও বেশি মাত্রায় নিউট্রিনো খুঁজে বের করতে কাজে আসবে। এমন কণার মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা জানতে ডিটেক্টর গভীর পানির নিচে বসতে হয়। নতুন স্থাপিত টেলিস্কোপটিতে আছে ২৪ হাজারের বেশি অপটিক্যাল সেন্সর। আরও আছে ১ হাজার ২১১টি তার বা স্ট্রিং, যা ৭০০ মিটার করে লম্বা। টেলিস্কোপের ডিটেক্টরটি চার কিলোমিটার ব্যাস এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি চালু হলে ১ দশমিক ৭ কিউবিক মাইল এলাকাজুড়ে নিউট্রিনোর জন্য স্ক্যান করবে। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম নিউট্রিনো ডিটেক্টরের নাম আইস কিউব। এটি অ্যান্টার্কটিকার আমুন্ডসেন-স্কট সাউথ পোল স্টেশনে অবস্থিত। বর্তমানে এই টেলিস্কোপ দিয়ে শুধু শূন্য দশমিক ২৪ কিউবিক মাইল এলাকা পর্যবেক্ষণ করা যায়। বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি ২০২৬ সালে চালু করবেন। ২০৩০ সালে ট্রাইডেন্ট পুরোপুরি কাজ শুরু করবে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও ফিজিকস ডট ওআরজি