আমাজন বন রক্ষায় ভূমিকা রাখা বিশ্বের সবচেয়ে দামি গরুর দাম কত
সবচেয়ে বেশি দামের গরু নিয়ে সবার বেশ আগ্রহ রয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সবচেয়ে দামি গরু নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের ‘নেলোর’ গরুর দাম ৪০ লাখ ডলার বা ৪৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা ধরে)। উচ্চমানের জেনেটিক উপাদানের কারণেই নেলোর জাতের গরুর দাম বেশি বলে মনে করা হয়। এই গরু ব্রাজিলের লাভজনক মাংসশিল্পে আধিপত্য বিস্তার করছে কয়েক দশক ধরে। বিশ্বে গরুর মাংস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ব্রাজিল ১ নম্বরে রয়েছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে এক নিলামে একটি সাদা রঙের নেলোর গরুর দাম উঠেছিল ৪৩ লাখ ডলার।
ব্রাজিলে বিশেষ গবেষণাগারে নেলোর জাতের গরুর ভ্রুণ নিয়ে গবেষণা করা হয়। জিনিয়াল নামের গবেষণাগারটি ব্রাজিলের গবাদিপশু ক্লোনিংয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগারগুলোর মধ্যে একটি। এখানে প্রতিবছর প্রায় ৭০টি ক্লোন করা প্রাণীর জন্ম হয়। ব্রাজিলের সাও ফেলিক্স ডো জিঙ্গুর শহরের বিভিন্ন খামারে প্রায় ২৪ লাখ পশু পালন করা হয়। সারা বিশ্বে ব্রাজিলের গবাদিপশুর মাংসের চাহিদা অনেক। ব্যবসা বাড়লেও তৈরি হচ্ছে পরিবেশগত সংকট। গবাদিপশু প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস নির্গত করে। কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়ে মিথেন বায়ুমণ্ডলের জন্য বেশি শক্তিশালী। আর তাই ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য গরুকে দায়ী করা হয়। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ গ্যাস নির্গমন হয় গরু পালন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির হিসাবে একটি গরু ১৫৪ থেকে ২৬৪ পাউন্ড মিথেন উৎপাদন করে। একটি গরু দৈনিক যে পরিমাণে মিথেন নির্গমন করে, তা কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়ে ২৫ থেকে ৮০ গুণ বেশি শক্তিশালী। সেই সংকটে বিকল্প হিসেবে ব্রাজিলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে জেবু গরু। উচ্চ তাপ সহ্য করে খরার মতো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার সহজাত ক্ষমতা আছে হাইব্রিড জেবু গরুর। জেবু গরু পালনকে পরিবেশবান্ধব মাংস উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। জেবুর জন্য কম চারণভূমির প্রয়োজন হয় বলে গবাদিপশুর পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করার সুযোগ রয়েছে। জেবু গরুর পরিবারের অন্তর্গত নেলোর গরু।
৬৫ বছর ধরে আমাজন বন গবাদিপশু পালনের জন্য উজাড়ের হুমকিতে রয়েছে। ব্রাজিলে এখন ২২ কোটি ৫০ লাখ গবাদিপশু পালন করা হয়। আগামী ২০ বছরে এর পরিমাণ ৩৫ শতাংশ বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে গবাদিপশুর জন্য আমাজন বন হুমকির মুখে পড়বে আরও বেশি। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রাজিলে গবাদিপশুশিল্পের সূচনা হয় বড় আকারে। ব্রাজিল সরকার কৃষকদের গ্রামাঞ্চলে যাওয়াকে উৎসাহিত করে বনকে চারণভূমিতে রূপান্তর করার জন্য প্রণোদনা দেয়। সেই সময় ব্রাজিল ক্রসব্রিডিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন গবাদিপশুকে উন্নত করার চেষ্টা করা হয়। তখন বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ব্রাজিলের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু ও বিভিন্ন রকমের বাস্তুতন্ত্র সহ্য করতে সক্ষম প্রাণীর খোঁজ চলছিল। সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবাদিপশুর খোঁজ করা হয়। তখন দক্ষিণপশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা ও জিনে জেবু নামের গরুর খোঁজ মেলে। এই গরুর বৈজ্ঞানিক নামে বস ইন্ডিকাস। জেবুকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাজিলে। এক দলিল থেকে জানা যায়, ভারতের মুম্বাই থেকে ব্রাজিলের কৃষকেরা জেবু প্রজাতির গরু আমদানি করা শুরু করেন। উঁচু পিঠ, লম্বা শিং, বিশাল কাঠামোর দেহ আর উঁচুর মাথার জেবু গরু বেশি সহনশীল। ব্রাজিলের তাপের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নেয় জেবু গরু। এ ধরনের গরুর অসংখ্য ঘামগ্রন্থি থাকার কারণে তাপমাত্রা বাড়লেও সমস্যা হয় না। গরুর ত্বকে আঁটসাঁট পুরু লোমের কারণে মশার মতো রক্তচোষা পোকামাকড়েরা তেমন সমস্যা করতে পারে না। জেবুর সঙ্গে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের নেলোর জেলা থেকে ওঙ্গোল প্রজাতির গরুর সংকরায়ণ করার পর নেলোর জাতের গরু পাওয়া যায়। নেলোর আরও বেশি জলবায়ুসহিষ্ণু ও টেকসই গবাদিপশু।
উন্নত প্রজাতির গরুর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে নানানভাবে। ব্রাজিলের উবেরাবার শহরের সবকিছুই যেন জেবু প্রজাতির গরুকেন্দ্রিক। নেলোর শুধু তাদের মাংসের জন্য পুরো ব্রাজিলজুড়ে ভীষণ জনপ্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ব্রাজিলিয়ান গবাদিবিশেষজ্ঞ রবার্ট উইলকক্স বলেন, মাংস উৎপাদন খাত কয়েক দশক ধরে বৈজ্ঞানিক পথে হাঁটছে। পশুপালনের পরিবেশগত প্রভাব থাকলেও স্বীকার করা হচ্ছে না। প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণের মাধ্যমে পশু পালনের ভবিষ্যৎ ঠিক করতে হবে। ব্রাজিলের গবাদিপশুচাষিরা বিভিন্ন খামারে জেনেটিক উপায়ে পশুর প্রজাতিতে উন্নতি আনার চেষ্টা করছেন। সেই লক্ষ্যে জেবু গরু অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে ব্রাজিলে গবাদিপশুশিল্পে ‘বই ইকোলজিকা’ বা পরিবেশবান্ধব বলদ ধারণা জনপ্রিয় হয়। নেলোর গরুর পরিবেশগত সুবিধার কথা ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। ব্রাজিলের আমাজন বন উজাড় অব্যাহত রয়েছে। গত ৬০ থেকে ৬৫ বছরে ব্রাজিলের প্রায় এক–পঞ্চমাংশ বন ধ্বংস হয়েছে। বন প্রাকৃতিক আধার হিসেবে কার্বন গ্রহণ করে উষ্ণায়নের মাত্রা দুর্বল করে। গত ৫০ বছরে আমাজন বন ৩ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়েছে। শুধু ২০২১ সালেই ৫ হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা উজাড় হয়েছে গবাদিপশু পালন ও ফসল চাষের জন্য। ভূপৃষ্ঠের ৪ ভাগের ১ ভাগ কার্বন ডাই–অক্সাইড এই বন শোষণ করে। বছরে যার পরিমাণ ২০০ কোটি টন, যা বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৫ শতাংশ। ১৯৯০ সালের পরে এটি ৩০ শতাংশ কমেছে।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক