তুলা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্যাটারি

তুলায় থাকা কার্বন প্রক্রিয়াজাত করে ব্যাটারি তৈরি করা হচ্ছেরয়টার্স

আপনার বালিশে কোন তুলা রয়েছে? শিমুল তুলার বালিশ নাকি সবচেয়ে ভালো। আর তাই তো তুলার রাজা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে শিমুল তুলা। আপনার বালিশে যে তুলাই থাক না কেন, এবার তুলায় থাকা কার্বন প্রক্রিয়াজাত করে ব্যাটারি তৈরি করছে জাপানের ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পিজেপি আই লিমিটেড। শুনতে অবাক লাগলেও ঘটনা কিন্তু সত্য। ব্যাটারি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় লিথিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ খনি থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এতে পরিবেশের ওপর  প্রভাব পড়ছে। আর তাই তুলা থেকে সংগ্রহ করা কার্বন ব্যবহার করে ব্যাটারি তৈরি করছে পিজেপি আই লিমিটেড। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ইনকেতসু ওকিনা বলেন, ‘আমরা বেশ গোপনীয়ভাবে ব্যাটারি তৈরি করছি। ব্যাটারির উপাদান,পরিবেশ সব গোপন রাখছি। প্রায় তিন হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আমাদের ব্যাটারির সেল তৈরি করা হয়। প্রতিটি ব্যাটারি সেলের জন্য কার্বন প্রয়োজন হয় মাত্র ২ গ্রাম। ১ কেজি তুলা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ২০০ গ্রাম কার্বন সংগ্রহ করা যায়।’

জানা গেছে, জাপানের ফুকুওকার কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশেষ ধরনের এই ব্যাটারি তৈরি করছে পিজেপি আই লিমিটেড। এই ব্যাটারিতে অ্যানোডের জন্য কার্বন ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যাটারিতে দুটি ইলেকট্রোড দণ্ড ব্যবহার করা হয় যার মধ্য দিয়ে চার্জ করার কণা আয়ন প্রবাহিত হয়। ব্যাটারি চার্জ করার সময় আয়ন একদিকে সরে যায়, আর অন্যদিকে যন্ত্রে শক্তি প্রদান করে। বেশির ভাগ ব্যাটারি গ্রাফাইটকে অ্যানোড দণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে। পিজেপি আইয়ের নতুন এ পদ্ধতি বেশ আলাদা ও টেকসই। তারা টেক্সটাইল শিল্পের বর্জ্য তুলা ব্যবহার করে অ্যানোড তৈরি করছে। পিজেপি আইয়ের তৈরি ব্যাটারির ক্ষমতা সাধারণ লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির তুলনায় ১০ গুণ বেশি। প্রতিষ্ঠানটি মূলত ডুয়েল কার্বন ইলেকট্রোড ব্যাটারি তৈরির জন্য কাজ করছে, যেখানে উভয় ইলেকট্রোডই উদ্ভিদভিত্তিক কার্বন থেকে তৈরি করা হয়ে থাকে। নতুন এই প্রযুক্তি জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা তৈরি করেছেন। এই ব্যাটারি ২০২৫ সালে বাজারে পাওয়া যাবে। চীনা প্রতিষ্ঠান গোকিয়া ও হিটাচি নতুন এই ব্যাটারি দিয়ে একটি ই-বাইক তৈরি করেছে যেটি একবার চার্জে সর্বোচ্চ ৭০  কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে।

বৈদ্যুতিক যানবাহনের পাশাপাশি শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ব্যাটারির গুরুত্ব অনেক। শক্তিশালী ব্যাটারির বিপুল চাহিদা থাকলেও কার্যকর ব্যাটারি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। লিথিয়াম আয়ন ও গ্রাফাইট ব্যাটারি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর তাই দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বিকল্পের সন্ধান করছেন গবেষকেরা। ব্যাটারি মূলত তিনটি মৌলিক উপাদান দ্বারা গঠিত। দুই পাশে দুটি ইলেকট্রোড ও মাঝখানে একটি ইলেকট্রোলাইট থাকে। একটি ইলেকট্রোড পজিটিভ চার্জের হয়, যাকে ক্যাথোড বলে। অন্যদিকে নেগেটিভ চার্জযুক্ত ইলেকট্রোডটিকে অ্যানোড বলা হয়। ব্যবহারের সময় চার্জযুক্ত আয়নকণা ইলেকট্রোলাইটের মাধ্যমে অ্যানোড থেকে ক্যাথোডে প্রবাহিত হয়। ইলেকট্রনগুলো ব্যাটারিতে যুক্ত বৈদ্যুতিক সার্কিটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। খনি থেকে সংগ্রহ করা লিথিয়াম ধাতু পেতে প্রচুর পানি ও শক্তির প্রয়োজন হয়। অপরদিকে গ্রাফাইট জীবাশ্ম জ্বালানি ও খনি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এর ফলে পরিবেশের ওপর বিভিন্ন প্রভাব পড়ে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইটসের বিশ্লেষক স্যাম উইলকিনসন বলেন, ব্যাটারি তৈরির উপাদান খনি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বাড়ছে। অনেক লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে কোবাল্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। আফ্রিকার দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোয় কোবাল্ট নিষ্কাশন করা হয়। পুরো প্রক্রিয়া বেশ বিপজ্জনক। আর তাই সমুদ্রের লবণাক্ত পানি, বিভিন্ন ধরনের জৈববর্জ্য থেকে শুরু করে নানান প্রাকৃতিক পদার্থের মধ্যে বিকল্প খুঁজছেন গবেষকেরা।
ফিনল্যান্ডের স্টোরা এনসো নামের একটি প্রতিষ্ঠান লিগনিন কার্বন ব্যবহার করে ব্যাটারির অ্যানোড তৈরি করেছে। গাছের পলিমারে এই কার্বনের দেখা মেলে। গবেষকেরা ক্যাথোড ও অ্যানোডের মধ্যে আয়ন প্রবাহকে সহজতর করতে ইলেকট্রোলাইটের জায়গায় তুলা ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। জার্মানির হেলমহোল্টজ ইনস্টিটিউট উলমের বিজ্ঞানী  স্টেফানো পাসেরিনি বলেন, ‘বিশাল মহাসাগরগুলো ব্যাটারির উপাদানের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে৷ ২০২২ সালে আমরা ধাতব সোডিয়ামের ভান্ডার তৈরির জন্য সমুদ্রের পানি ব্যবহার করেছি। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে সোডিয়াম আয়ন স্থানান্তর করতে সক্ষম ব্যাটারির নকশা তৈরি করেছি আমরা। বিশেষ এই নকশায় সোডিয়াম আয়ন দ্রুত চলে যায়। সমুদ্রের পানি এখানে ক্যাথোড বা ধনাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রোড হিসাবে কাজ করে। এই ব্যাটারিতে কোনো অ্যানোড নেই। কারণ, সোডিয়াম নেগেটিভ চার্জ হয় না। নিরপেক্ষ আকারে জমা হয়। যখন আপনার শক্তির প্রয়োজন হবে, তখন প্রক্রিয়াটি বিপরীত দিকে চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যাবে।

সূত্র: বিবিসি