মোনালিসার হাসির আড়ালে বিষ!

বিশেষ কাচের ভেতরে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা।
রয়টার্স

লেওনার্দো দা ভিঞ্চির পৃথিবীখ্যাত শিল্পকর্ম মোনালিসার হাসি নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। হাসির পেছনে কী লুকিয়ে আছে, তা নিয়ে বোদ্ধাদের কম পরিশ্রম হয়নি। অনেকেই বলেছেন হাসির রহস্যময়তার কথা। এবার পুরোই ভিন্ন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মোনালিসার হাসিতে নাকি বিষ রয়েছে!

গবেষকেরা লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা ছবিতে বিষাক্ত রঙের মিশ্রণের অস্তিত্ব টের পেয়েছেন। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীদের একটি দল লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা নিয়ে নতুন গবেষণা তথ্য প্রকাশ করেছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নমুনা বা মাইক্রোস্যাম্পল থেকে উচ্চমাত্রার লেড বা সিসা ও সিসাযুক্ত সাদা রঙের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মূল মোনালিসা ছবিতে ব্যবহৃত স্যাপোনিফায়েড তেলের মিশ্রণে এসব বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। ছবিতে প্লাম্বোনাক্রিট নামের বিরল যৌগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, এই যৌগ শুধু ক্ষারীয় পরিবেশে স্থিতিশীল থাকতে পারে।

লেওনার্দো দা ভিঞ্চি যে সময়ে ছবি আঁকতেন, সেই পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকের অনেক ছবি কাঠের প্যানেলে আঁকা হতো। সেই কাঠামোতে ছবি আঁকার আগে অন্য কোনো রঙের স্তর দিয়ে লেপে নেওয়া হতো। ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস-স্যাকলের বিজ্ঞানী ভিক্টর গঞ্জালেজের নেতৃত্বে গবেষকেরা এই বিষের সন্ধান পেয়েছেন।

লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ছবি আঁকার সময় সিসার সাদা রঞ্জকের পুরু স্তর দিয়ে ছবি আঁকতেন। তিনি তেলের সঙ্গে লেড মনোক্সাইড ব্যবহার করে পরীক্ষা করেন। এই রঞ্জক ব্যবহার করলে কমলা রঙের আবহ তৈরি হয়, যা ছবি শুকানোর পরে বোঝা যেত। ভিঞ্চি তাঁর ‘লাস্ট সাপার’-এর নিচের দেয়ালে একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। যদিও সেই সময়ে ফ্রেস্কো কৌশল ব্যবহারের চল ছিল বেশি। দুটি পেইন্টিংয়ের কাঠামোর নিচের স্তরের নমুনা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়।

মোনালিসা ছবির কোণ থেকে একটি ক্ষুদ্র নমুনা সংগ্রহ করেন বিজ্ঞানীরা। একই সঙ্গে ‘লাস্ট সাপার’-এরের ওপরিতল বা সারফেস থেকে ১৭টি মাইক্রোস্যাম্পল সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়। এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন আর ইনফ্রারেড (অতি লাল রশ্মি) স্পেকট্রোস্কোপি কৌশল ব্যবহার করেন গবেষকেরা। শিল্পকর্মগুলোর নিচের স্তরে কেবল তেল ও সাদা সিসা নয়, বিরল সিসা যৌগ প্লাম্বোনাক্রিটের সন্ধান পাওয়া গেছে।

এই উপাদান  ইতালীয় রেনেসাঁর সময়কার চিত্রকর্মে দেখা যায় না। যদিও পরবর্তী সময়ে ষোড়শ শতকে অবশ্য ডাচ্‌ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্টের বিভিন্ন চিত্রে এই যৌগের খোঁজ পাওয়া যায়। ‘লাস্ট সাপার’ থেকে নেওয়া নমুনায় লেড মনোক্সাইডের অক্ষত দানার খোঁজ পাওয়া গেছে। লেড মনোক্সাইড তখন ত্বক ও চুলের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। যদিও এটি এখন বিষাক্ত উপাদান বলে পরিচিত।

আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে মোনালিসার ছবির রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের ইতালীয় শিল্পবিশেষজ্ঞ ও কিউরেটর কারমেন বাম্বাচ বলেন, ‘নতুন গবেষণার তথ্য নিয়ে আমরা খুবই উত্তেজিত। লেওনার্দোর চিত্রকলার কৌশল সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকভাবে নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি আমরা। সেই সময়কার শিল্পজগৎ সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। মোনালিসা শিল্পকর্মে প্লাম্বোনাক্রিট খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি চিত্রশিল্পী হিসেবে লেওনার্দোর সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করছে। তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ছবি আঁকতেন। তাঁর আধুনিক মনোভাবের কারণে এই রাসায়নিক যৌগ দিয়ে তিনি ছবি এঁকেছেন। প্লাম্বোনাক্রিট অনেকটা তাঁর ছবি আঁকার একটি রেসিপি। প্রথমবারের মতো আমরা রাসায়নিকভাবে বিভিন্ন যৌগের সন্ধানকে নিশ্চিত করতে পেরেছি। সেই সময়কার ছবি আঁকার এই রেসিপি শতাব্দীর পর শতাব্দী চালু ছিল। লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ঘন ও দ্রুত শুকানো পেস্ট তৈরি করে ছবি আঁকতেন। পেস্ট তৈরি করতে তিসি বা আখরোটের তেলের সঙ্গে কমলা রঙের লেড অক্সাইড পাউডার ব্যবহার করতেন। এর ফলে খুব সুন্দর সোনালি রং তৈরি করা যায়। এখনো লেওনার্দোর জীবন ও কাজ থেকে অনেক কিছু আবিষ্কার করার বাকি আছে। বলা যায়, বিশাল দেয়ালের মধ্যে আমরা মাত্র একটুকরা ইটের খোঁজ পেয়েছি। ধারণা করা হয়, মোনালিসা ছবিটি লিসা ঘেরার্ডিনির প্রতিকৃতি। তিনি একজন ফ্লোরেনটাইন সিল্ক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ছিলেন। অনেকেই দাবি করেন, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি অ্যালকেমির চর্চা করতেন বা অ্যালকেমি সম্পর্কে জানতেন।’

১৪৬৬ সালে লেওনার্দো ১৪ বছর বয়সে শিল্পী ভ্যারিচ্চিওর কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। ষোড়শ শতাব্দীর জীবনীলেখক ভাসারির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, লিওনার্দো অ্যালকেমির নানা কৌশল জানতেন। সেই কৌশলের মাধ্যমেই তিনি ছবি আঁকতেন।

সূত্র: সাই ডটনিউজ ও ফিজ ডটওআরজি