বন্যাকবলিত ফেনীতে অ্যামেচার রেডিও দিয়ে যেভাবে যোগাযোগব্যবস্থা চালু হলো  

ফেনীতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অ্যামেচার রেডিও নিয়ে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরাঅ্যামেচার রেডিও অপারেটর জিহাদের সৌজন্যে

ভয়ানক এক দুর্যোগ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে আমাদের দেশে কদিন আগে। কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই গভীর রাতে বাংলাদেশের আটটি জেলা প্লাবিত হয়ে গেল। প্রত্যন্ত স্থানগুলোতে মোবাইল ফোন কাজ করছে না, ইন্টারনেটও নেই, ব্যাহত যোগাযোগব্যবস্থা। এ রকম পরিস্থিতিতে অ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম অপারেটররাই পারেন দ্রুত জরুরি যোগাযোগ (ইমারজেন্সি কমিউনিকেশন) দিয়ে সহায়তা করতে। যখন আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা সব বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন কোনো অ্যামেচার রেডিও অপারেটর তাঁর নিজস্ব বেতারযন্ত্র দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে থাকেন।

বন্যার দুদিন পরে অস্ট্রেলিয়া থেকে রবিন (অ্যামেচার রেডিও পরিচিতি নম্বর: ভিকে২ভিআরবি/এস২১আরবি) কল করে বললেন, দেশের অ্যামেচার রেডিওর অপারেটররা এরই মধ্যে দুর্যোগপূর্ণ স্থানে চলে গেছেন এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বেতার বা রেডিও যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। জেলো অ্যাপ দিয়ে ‘ফ্লাড কন্ট্রোল’ গ্রুপে আমিও যুক্ত হলাম ঢাকার অ্যামেচার রেডিও বন্ধুদের সঙ্গে।

অ্যামেচার রেডিওর কাজের ধরণ
লেখকের সৌজন্যে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে রাগিব নাইম আমাকে জানালেন, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় সানজানা ও তাঁর স্বামী একটা স্কুল ঘরে দুদিন ধরে আটকা পড়ে আছেন। তাঁদের জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করতে হবে। কারণ, সানজানা অন্তঃসত্ত্বা। আমি ফাহাদ (এ২১এএফ) আর সজল (এস২১ডিএসি) দুজনকে বার্তাটা পাঠিয়ে দিই। তাঁরা ফেনীর কন্ট্রোল স্টেশনে যোগাযোগ করেন, সেখান থেকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের কাছে খবরটা পৌঁছায়। এভাবেই দু-তিনটা নেটওয়ার্কজুড়ে অ্যামেচার রেডিও নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকেরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

আমি দেশে থাকার সময়ে (গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে) ঘূর্ণিঝড়ের সময় অ্যামেচার রেডিও দিয়ে যোগাযোগ স্থাপনে যুক্ত ছিলাম। তখন ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের ব্যবহার সহজলভ্য ছিল না। তা ছাড়া আমরা বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পেতাম। মূলত উপকূল অঞ্চলজুড়েই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব চলত। কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, হঠাৎ করেই রাতের আঁধারে শহর-গ্রাম সব তলিয়ে গেল।

ফেনী শহরকে কেন্দ্র করে ৭০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ নিয়ে স্থানটিতে মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই এলাকায় প্রচলিত যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখানেই অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা যোগাযোগসেবা প্রতিষ্ঠা করে সারা দেশের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছেন। ফেনীর জেলা প্রশাসক কার্যালয় (ডিসি অফিস) থেকে তাঁরা সেনাবাহিনী, রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার ব্রিগেড—সবাইকে যোগাযোগের আওতায় এনে তথ্যগুলো সঠিক স্থানে পাঠাচ্ছেন। সেই তথ্যের ওপর অন্যান্য সংস্থা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় একজন অ্যামেচার রেডিও অপারেটর
অ্যামেচার রেডিও অপারেটর জিহাদের সৌজন্যে

অ্যামেচার রেডিওর স্বেচ্ছাসেবকেরা কীভাবে ফেনী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দলে যুক্ত হলেন?

২১ আগস্ট সন্ধ্যায় ফাহাদ (এস২১এএফ, এস২১সিপি), জিহাদ (এস২১এমওবি) ও আলম (এস২১একে) ঢাকায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে শুনলেন, একজন রেডিও অপারেটর স্কাউট ও ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ফেনীতে যাচ্ছেন সহায়তা করার জন্য। এটা শুনেই ফাহাদরা ঠিক করলেন, তাঁরাও যাবেন সব রেডিও যন্ত্রপাতি নিয়ে। কেননা ফেনীতে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ও খুলনার আরও অন্য হ্যামদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিক হলো, খুব সকালেই চারজনের একটা অগ্রগামী দল ফেনীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাবে।

মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা লাইফ জ্যাকেট, রেডিও , ব্যাটারি, শুকনা খাবার ইত্যাদি জোগাড় করে ফেললেন এবং পরদিন ভোরে ফেনীর উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। ২২ আগস্ট সকালে ফেনী থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে মিয়াবাজার এলাকায় গিয়ে তাঁদের বাস আর এগোতে পারছিল না। রাস্তায় পানি ও যানজট মিলে এক হযবরল অবস্থা। তখন তিনজন হ্যাম স্বেচ্ছাসেবকেরা বাস থেকে নেমে রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন, কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পর তাঁরা একটি বাইপাস ধরে কোনোরকমে ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌঁছান।

ফেনীতে উঁচু ভবনের ছাদে অ্যামেচার রেডিওর অ্যানটেনা বসানো হচ্ছে
অ্যামেচার রেডিও অপারেটর জিহাদের সৌজন্যে

জেলা প্রশাসক শাহিনা আক্তারকে যখন বুঝিয়ে বললেন অ্যামেচার রেডিও কী এবং তাঁরা কীভাবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাহায্য করতে পারবেন, জেলা প্রশাসক সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। তিনি তাঁদের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মধ্যেই রেডিও স্টেশন স্থাপন করার জায়গা করে দেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে ফেনীতে তখন মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ এবং বিদ্যুৎ-সংযোগও নেই। ফেনী যেন একটি বিচ্ছিন্ন জেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিল না।

অ্যানটেনা যদি অনেক ওপরে ওঠানো যায়, তাহলে ভিএইচএফ (ভেরি হাই-ফ্রিকোয়েন্সি) কভারেজ আরও বাড়বে, এমনকি ঢাকা পর্যন্ত ওয়াকিটকির সংকেত পৌঁছে যেতে পারে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কাছাকাছি ১৫ তলা উঁচু একটা দালানে আরেকটা রেডিও স্টেশন বসানোর জায়গা দেওয়া হলো। ঢাকার কাকরাইলে স্কাউট ভবনের ওপরে হ্যাম অপারেটর রাব্বি (এস২১আরসি) ও আরও কজন মিলে একটা ফিফটিন এলিমেন্টের ইয়াগি অ্যানটেনা ও বেজ স্টেশন স্থাপন করলেন। এখান থেকে বার্তার সম্প্রচার করলে ফেনীতে সংকেত গ্রহণ করা যাচ্ছিল। কিন্তু ফেনীতে এত বড় অ্যানটেনা না থাকায় ফেনীর সংকেত ঢাকা গ্রহণ করতে পারছিল না। যা-ই হোক, একমুখী যোগাযোগ (ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন) তো হলো। তার মানে, ঢাকার বার্তা ফেনী গ্রহণ করবে ১৫ তলার ছাদ থেকে। সেখান থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো (রিলে) হবে। রাত নাগাদ পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গেল।

এর মধ্যে ফেনীর ডিসি অফিসে অ্যামেচার রেডিওর এই সুবিধা দেখে সেনাবাহিনীর দলও সংযুক্ত হতে চাইল। তাদের জায়গায় আরেকটি বেজ স্টেশন বসানো হলো। অন্ততপক্ষে একজন অ্যামেচার রেডিও অপারেটর সার্বক্ষণিকভাবে সেখানে থাকবেন বলে সাব্যস্ত হলো।

কাজ হলো যেভাবে

অ্যামেচার রেডিওর মাধ্যমে কাজটা এ রকম দাঁড়াল, ঢাকা ও অন্যান্য জায়গা থেকে যেসব ত্রাণ এবং বন্যাকবলিত এলাকা থেকে যেসব উদ্ধারের অনুরোধ আসবে, সেগুলো ডিসি অফিসে তালিকাভুক্ত করা হবে। ফেনী সদর ও আশপাশের উপজেলার কর্মকর্তা বা অন্য যাঁরা উদ্ধারকাজে যাবেন, তাঁদের সঙ্গে একজন অ্যামেচার রেডিও অপারেটর দেওয়া হবে এবং তাঁরা সেখান থেকে ১৫ তলায় থাকা অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ১৫ তলার রেডিও স্টেশন থেকে ডিসি অফিসে তথ্য যাবে।

সারা দিন এভাবে বার্তা সংগ্রহ হতে থাকবে এবং প্রতিদিন সকালে সেনাসদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন কোথায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে বা কোথায় ত্রাণ পৌঁছাতে হবে। এক দিন না যেতেই সবাই বুঝে গেলেন অ্যামেচার রেডিও কীভাবে তাঁদের যোগাযোগে সহায়তা করছে। হাসপাতাল ও সেনাবাহিনীর মেডিকেল ক্যাম্পেও রেডিও স্টেশন বসানোর সিদ্ধান্ত হলো। এর মধ্যে অ্যামেচার রেডিও অপারেটর অনুপ (এস২১টিভি), দুরন্ত (এস২১জেডডিআর), হুজাইফা (এস২১আরএবি) এবং আরও কয়েকজন আরেকটি রেডিও সেটআপ তৈরি করেছেন। তাঁদের স্টেশনে একটা রিপিটারও বসানো হয়েছিল।

রেডিও অপারটের জাহিদ জানালেন, তাঁরা দ্বিতীয় দিনে রেডিওতে একটা ডিস্ট্রেস কল পান। যেটা এসেছিল অ্যামেচার রেডিও অপারেটর আসিফের (এস২১এনডব্লিউআর) কাছ থেকে। তিনি তিন দিন ধরে প্রত্যন্ত এক জায়গায় পানিবন্দী হয়ে আটকে আছেন। সেখান থেকে কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ফেনীতে রেডিও স্টেশন বসানোর পর আসিফ অন্যদের কথাবার্তা শুনে ‘ডিস্ট্রেস কল’ দেন। আসিফের বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দল পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।

ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যার পানির মধ্যে কেবল কিছু শুকনা খাবার খেয়ে, অ্যামেচার রেডিও স্বেচ্ছাসেবকেরা যে সেবার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, তা এককথায় অনন্য। দেশে অ্যামেচার রেডিও লাইসেন্স পেতে ও একটা যুগোপযোগী রেডিও পাওয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আশা করি এবারের বন্যায় স্বেচ্ছাসেবকদের কার্যক্রম দেখে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) তাদের নিয়মাবলি যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত নেবে।

মুনীম হোসেন রানা: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পদার্থবিদ, অ্যামেচার রেডিও পরিচিতি নম্বর কেএফ৫আইভিএল ও এস২১আর