উই ট্রাস্টের বিরুদ্ধে আইসিটি বিভাগে নারী উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, তদন্তের দাবি
ফেসবুক গ্রুপভিত্তিক ই-কমার্স ও এফ-কমার্স নারীদের সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের (উই) শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনে কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বরাবর স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। গতকাল রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারের সামনে এক প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন আয়োজন করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন এই নারী উদ্যোক্তারা। ‘বৈষম্যবিরোধী ই-কমার্স এবং এফ-কমার্স নারী উদ্যোক্তা’ সংগঠন নামে তাঁরা স্মারকলিপি জমা দেন।
আবেদনকারী হিসেবে ‘আমরা ভুক্তভোগী নারী উদ্যোক্তাগণ’ উল্লেখ করে স্মারকলিপিতে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকের সহযোগিতায় উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং সাধারণ নারী উদ্যোক্তাদের মানসিক ও আর্থিক হয়রানি, ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। স্মারকলিপিতে উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন সরকারি প্রশিক্ষণের নামে নিবন্ধন বাবদ চাঁদা আদায় করা হয়। উদ্যোগবিষয়ক ‘মাস্টারক্লাস’ করানোর নামেও টাকা নেওয়া হয়। সরকারি অনুদানের কথা বলা হলেও ক্লাস করার জন্য ফি ও গ্রুপে থাকার জন্য তিন হাজার টাকা করে গ্রাহক ফি নেওয়া হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে।
উই সামিট নিয়ে স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, আইসিটি বিভাগের ব্যানারে এ আয়োজনে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে স্টলভাড়া বাবদ বিভিন্ন ফি সংগ্রহ করা হয়েছে। বিভিন্ন কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্যও চাপ প্রয়োগ করা হতো। বিদেশে উদ্যোক্তা প্রতিনিধি পাঠানোর নাম করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম আলোর কাছে বেশ কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, ৫০ হাজার টাকা করে উই প্রস্তাবিত তালিকা অনুযায়ী কয়েক শ নারী উদ্যোক্তাকে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছে। এটা ছিল নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, পণ্য ও সেবার মান উন্নয়নের জন্য। ৫০ হাজার টাকা থেকে নিবন্ধন ফি, ওয়েবসাইট তৈরি ও প্রকাশের জন্য এই অনুদান থেকে ১৩ হাজার টাকা কেটে রাখা হতো উইয়ে। ২০২২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ১ হাজার নারী উদ্যোক্তাকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। একই বছর শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনেও ২৫০ জন নারী উদ্যোক্তাকে সমপরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। অনুদানপ্রাপ্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উদ্যোক্তা উইয়ের সদস্য।
স্মারকলিপি প্রদান প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ই-কমার্স এবং এফ-কমার্স নারী উদ্যোক্তা সংগঠনের ঢাকা জেলার আহ্বায়ক রাজিয়া মুন আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উই নারী উদ্যোক্তাদের একটি প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মের নারী উদ্যোক্তারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। সেই বৈষম্যের বিষয়টি আইসিটি উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরার জন্য প্রতিবাদ ও মানববন্ধন আয়োজন করি আমরা। আমাদের প্রতিবাদ ও স্মারকলিপি আইসিটি সচিবের মাধ্যমে উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে।’
চট্টগ্রামের নারী উদ্যোক্তা সানজিদা আফরোজ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশের জন্য উই প্ল্যাটফর্মে দেশের নানা প্রান্তের নারী উদ্যোক্তারা যুক্ত হন। কিন্তু উই শুরু থেকেই বিভিন্ন উপলক্ষ ও সরকারি প্রশিক্ষণের জন্য নিবন্ধনের নামে বিভিন্ন সময়ে চাঁদা আদায় করে গেছে। আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন অনুদান পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ফি কিংবা ক্লাসের জন্য টাকা গ্রহণ করা হতো। মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন অনুদান গ্রহণ করলেও তা ঠিকমতো নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়া হয়নি। বিনা মূল্যের অনেক অনুষ্ঠানের জন্য টাকাও আদায় করা হয় নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। এ বিষয়গুলোর বিচার চেয়ে আমরা প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছি। আমরা চাই অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’
স্মারকলিপিতে করা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তারের সঙ্গে। আজ বিকেলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকজন নারী উদ্যোক্তার প্রতিবাদ ও মানববন্ধনের কথা আমি শুনেছি। ই-কমার্স ও এফ-কমার্সে দেশের অনেক নারী যুক্ত। আমাদের সংগঠনটি অনেক বড়, দেশের নানা প্রান্তের নারী উদ্যোক্তারা যুক্ত আছেন। যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করে ভুল ধারণা ও বিভ্রান্তি দূর করতে চাই। যাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে চাই। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করবেন বলে শুনেছি। আমরা এই খাত-সংশ্লিষ্ট যেকোনো উন্নয়নকেই গুরুত্ব দিই।’
২০১৭ সালের অক্টোবরে ফেসবুক গ্রুপ হিসেবে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) যাত্রা শুরু করে। করোনা মহামারির সময় এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। গ্রুপে নারী উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ক্রেতারাও যুক্ত হন। ফলে করোনা মহমারির বিপর্যয়ের সময় অনেক নারী বিকল্প আয়ের সন্ধান পান। বর্তমানে উইয়ের ফেসবুক গ্রুপে দেশের প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ নারী ও পুরুষ যুক্ত আছেন। তবে সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী এফ-কমার্স উদ্যোক্তা। গত মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উইয়ের সদস্য অনেক নারী উদ্যোক্তা উই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে ওঠেন।
উইয়ের ফেসবুক গ্রুপ চালু থাকলেও সংগঠনের ফেসবুক পেজ এখন বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে নাসিমা আক্তার জানান, ‘কারিগরি ত্রুটির জন্য ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ফেসবুক পেজটি সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। আমরা ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। দ্রুতই ফেসবুক পেজটি সক্রিয় হবে বলে মেটার পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে।’