দিনে ১২ ঘণ্টা ফ্রিল্যান্সিং, ২ ঘণ্টা পড়াশোনা
১৬ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্সার সোহেল এসএসসিতে পেল জিপিএ ৪.১১
সোহেল রানার বয়স মাত্র ১৬ বছর। থাকে লালমনিরহাট সদর উপজেলার কর্ণপুরে। দুড়াকুটি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আজ তার ফলাফল প্রকাশিত হলো। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সোহেল পেয়েছে জিপিএ ৪.১১। ফোন করতেই শোনা গেল তার উচ্ছ্বাস। সোহেল বলল, ‘দিনে ১২ ঘণ্টা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করি। এসএসসির জন্য প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে নিয়মিত পড়াশোনা করেছি। তাই এই ফলাফল আমার কাছে অমূল্য।’
গত মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিল সোহেল। সোহেল এই বয়সেই বাড়িতে বসে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ে সফলতা পেয়েছে। সেই সূত্রেই কথা হয় সোহেলের সঙ্গে। তার বাবা মো. মজিবর রহমান কৃষিকাজ করেন। মা মোছা. মর্জিনা বেগম গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট সোহেল রানা। বাড়িতে সচ্ছলতা আনতেই ফ্রিল্যান্সিং করে সোহেল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনার সময় মিডিয়া বায়িং ও ওয়েব অ্যানালাইসিসের কাজ শিখে ফ্রিল্যান্স কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট অর্থাৎ অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করা শুরু করেন। সঙ্গে চলতে থাকে পড়াশোনা। ধীরে ধীরে আয় বাড়তে থাকে সোহেলের। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে প্রতি মাসে তার গড় আয় তিন হাজার ডলার (৩ লাখ টাকার বেশি)।
সোহেল রানা বলেন, আমি বেশি কাজ করি ফাইভার ও আপয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে। এর বাইরেও কিছু স্থায়ী কাজের গ্রাহক রয়েছেন। যাঁরা সরাসরি আমাকে কাজ দেন।
সোহেল রানা যে কাজগুলো করেন, সে সম্পর্ক জানালেন। ওয়েব অ্যানালিটিকস ও মিডিয়া বায়িং হলো ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবসা করার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ও প্রক্রিয়া। এগুলো পেশাদার মানের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ডিজিটাল প্রচারণা চালানো হয়। ওয়েব অ্যানালিটিকস থেকে ওয়েবসাইটের নানা পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচারের কাজটি করা হয়। এটি পরিসংখ্যানের তথ্য দেয়, যা ব্যবসায়িক কর্মক্ষেত্র উন্নত করতে সাহায্য করে। সোহেলের কাজ হলো, এসব তথ্য পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন গ্রাহকের পণ্যের প্রচার সঠিকভাবে চালানো।
সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলে, আমি এবার কলেজে ভর্তি হব। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে যাব এবং এই পেশায় আরও ভালো করার চেষ্টা করব। আমার পরিকল্পনা, নিজের এজেন্সি চালু করার।
সোহেল সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাবা একটা ফোন কিনে দেন। সোহেল মুঠোফোন দিয়ে ইন্টারনেটে দেখে যে আসলেই ফোন দিয়ে টাকা আয় করা সম্ভব কি না। তখন স্থানীয় এক বড়ভাই তিন হাজার টাকায় প্রশিক্ষণ কোর্স করাচ্ছিলেন। কোর্সের বিষয় ছিল ‘অনলাইনে ফোন দিয়ে কীভাবে আয় করা যায়। অনেক কষ্টে মায়ের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা জোগাড় করে সোহেল সেই কোর্স করেন। কিন্তু চার মাসের সেই কোর্সে কোনো কাজ শিখতে পারেনি সোহেল। টাকা আয়ও করতে পারেনি।
এরপর সোহেলের মুঠোফোনটিও নষ্ট হয়ে যায়। তখন এল করোনাকাল। সোহেল তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সোহেলের ইচ্ছা ল্যাপটপ কম্পিউটার কেনার। অনেক বলার পর তার বাবা ২৮ হাজার টাকায় একটি পুরোনো ল্যাপটপ কিনে দেন।
সোহেল বলে, ল্যাপটপ কেনার পর কীভাবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তার খালাতো ভাই লাইভ ফর লাইক নামে একটা ওয়েবসাইটে কাজ করতেন। আমি তাঁকে বলি, ‘তুমি কীভাবে কাজ করো তা শিখিয়ে দাও।’ সেই ভাই আমাকে শেখান। পরের চার-পাঁচ মাসে আমি গড়ে তিন হাজার টাকা আয় করি। সে টাকা আমি আমার আম্মুর হাতে দিই। এটা আমি একটি ওয়েবসাইট থেকে আয় করেছিলাম।
সৌদিপ্রবাসী সোহেলের পরিচিত এক ভাই তাকে ফ্রিল্যান্সিং করার পরামর্শ দেন। ডিজিটাল মার্কেটিং এখন অনেক ভালো চলছে, তাই তিনি সোহেলকে ডিজিটাল বিপণন শিখতে বলেন। অনলাইনে একটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পায় সোহেল। কোর্স ফি ছিল প্রায় দুই হাজার টাকা। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোর্স শুরু করে সোহেল। কোর্স সম্পন্ন করার পর ইনস্টাগ্রামে প্রথম একজন গ্রাহকের কাজ পায় সোহেল। সেটি ছিল ২৫ ডলারের। গ্রাহক তাঁর কাজে খুশি হয়ে সোহেলকে ২৫ ডলার টিপস দিয়েছিলেন।
এরপর ফাইভার ও আপওয়ার্কে অ্যাকাউন্ট খোলেন সোহেল। ধীরে ধীরে কাজ বাড়তে থাকে। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, এখন কাজ করছে সোহেল নিজ গ্রামে বসেই। সোহেল বলে, ‘আমি এজেন্সি করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। আমার কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’