রাজধানীর তিতুমীর কলেজ থেকে ২০১৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে চাকরিই খুঁজছিলেন মিজানুর রহমান। কিন্তু চাকরি পাচ্ছিলেন না তিনি। কিন্তু মিজানুর হাল ছাড়েন না, চাকরির পেছনেই লেগে থাকেন। চাকরিও পেয়ে যান একসময়। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর কাজ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্যের উত্তর দেওয়া। প্রতিষ্ঠানের সেবা সম্পর্কে বা কোনো তথ্য কেউ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে উত্তর দেওয়া। তা ছাড়া মিজান ভিডিও সম্পাদনার কাজও করে দিতেন। বেতন খুব বেশি ছিল না। তবে মিজানুরের চলে যাচ্ছিল। কিন্তু করোনাকালে ঢাকায় আর থাকতে পারলেন না। চলে যেতে হলো পাবনার চাটমোহর উপজেলায় নিজের গ্রাম উথুলীতে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট মিজানুর। তাঁর বাবা পলান প্রামাণিক একটা স্টেশনারি দোকান চালান।
আজ সোমবার মুঠোফোনে কথা হয় মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা মহামারির লকডাউনের সময় কেউ বাইরে বের হতে পারছিল না। একদিন দেখলাম, এলাকার বাবু ভাই মাছ ধরতে যাচ্ছেন চলনবিলে। আমাকে বললেন, “বসে থেকে কী করবি, চল মাছ ধরতে যাই।” আমি দেখতাম, ছিপ–বড়শি দিয়ে টোপে টোপে মাছ ধরছেন তিনি। প্রতিটি টোপেই মাছ উঠছে। এমনকি তিনি বলে বলে ফোন ধরছেন। একবার ট্যাংরা তো একবার শিং। বিষয়টি আমার বেশ ভালো লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করলাম। তারপর আমার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিওটি ছেড়ে দিলাম। ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। প্রথম দিনেই দেড় লাখবার দেখা হয় সেটি।’
এরপর মিজানুর ভাবলেন, গ্রামে মাছ ধরার এই বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ আছে। এই দৃশ্য দেখে দর্শকেরা মজা পান, আবার গ্রামীণ ঐতিহ্যকেও তুলে ধরা যায়। ইউটিউবে মিজানুর নিজের ব্যক্তিগত চ্যানেলের নাম বদলে রাখলেন ন্যাচারাল ফিশিং বিডি। ছিপ বড়শি, পলো, জাল—নানা পদ্ধতির মাছ শিকারের ভিডিও বানিয়ে, সম্পাদনা করে সেগুলো ইউটিউবে প্রকাশ করা শুরু করেন মিজানুর। ধীরে ধীরে এই চ্যানেল থেকে আয় হতে থাকে।
মিজানুর ইউটিউবের জন্য ভিডিও বানাতেন, এ নিয়ে স্থানীয় অনেকে তাঁর বাবার কাছে অভিযোগও করেছেন। ছেলে কিছুই করে না, সারা দিন ভিডিও করে—এই ছিল তাঁদের বক্তব্য। আর এখন মিজানুরকে সবাই উৎসাহ দেন, তাঁর প্রশংসা করেন। শুরুতে একাই সব করতেন। এখন মিজানুরের সঙ্গে কাজ করেন আরও ছয়জন। তবে ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা ও এডিট, ভিডিও আপলোডের কাজটি তিনি করে থাকেন। বাকিরা মাছ ধরেন, মাছ ধরার আয়োজন করেন।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই মাছ ধরার ভিডিও দিয়ে এখন ভালোই আয় হচ্ছে। আমাদের ন্যাচারাল ফিশিং বিডি চ্যানেলে এখন পাঁচ লাখের বেশি গ্রাহক (সাবস্ক্রাইবার) রয়েছেন। মাসে কমবেশি ৩ হাজার ৫০০ ডলার আয় হয়। আমার দলের সদস্যের বেতন, অন্যান্য খরচ করে মাসে আমার হাতে কমবেশি এক হাজার ডলার থাকে। ফেসবুক পেজেও ফলোয়ার সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি।’
মিজানুর রহমান মাছ ধরার ভিডিও করা আর তা ইউটিউবে প্রকাশ করার কাজেই নিজেকে আটকে রাখেননি। তিনি মাছ চাষও শুরু করেছেন। মিজানুর বলেন, ‘ছয় মাস আগে আট বিঘার একটি পুকুর ইজারা নিয়েছি। এতে মাছ ছেড়েছি। আধা কেজি ওজনের যেসব মাছ ছেড়েছিলাম, সেগুলোর ওজন এখন দেড়-দুই কেজি হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে এই পুকুরে মাছের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, দুবার জাল দিয়ে ধরেছি। দুবারে প্রায় আড়াই লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছি।’
যাঁর উৎসাহে মাছ ধরা দেখতে গিয়েছিলেন করোনার সময়, সেই ইয়াসিন আলী বাবু স্থানীয় মানুষদের কাছে ‘ফিশিং বাবু’ নামে পরিচিত। তিনি তুখোড় মাছশিকারি। মিজানুর বলেন, ‘এখন আমরা ইউটিউবে চাচা-ভাতিজা একটা ভিডিও সিরিজ চালু করেছি। সেখানে বাবু ভাইকে নিয়ে মাছ ধরার মজার ভিডিও করা হয়। এগুলো খুবই সাড়া পাচ্ছে।’
ভবিষ্যতে মিজানুর তাঁর মাছ ধরার ভিডিও দলটি আরও বড় করতে চান। মিজানুর বলেন, ‘আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী। তাঁদের নিয়ে আরও কাজ করব।’
মিজানুর রহমান ইউটিউব থেকে আসা তাঁর প্রথম আয় দিয়ে করোনার সময়ে মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। গ্রামের অসুস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য করেছেন তিনি, বিভিন্ন সামাজিক কাজও করছেন। সবকিছুর পর বড় বিষয় হলো, ইউটিউবার মিজানুর বাংলাদেশের মাছ ধরার ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অন্তর্জালে।