২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাবাকে বাঁচাতে কম বয়সে দুই ভাইয়ের ফ্রিল্যান্সিং

নিজেদের বাসায় মা সুলতানা রাজিয়া, বাবা রুবেল মিয়ার সঙ্গে শুভ সরকার ও সৈকত সরকার
প্রথম আলো

আজ ১৮ জুন। জুনের তৃতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় বাবা দিবস। বাবাকে শুভেচ্ছা জানায় সন্তানেরা, উপহার, বিশেষ ‘ট্রিট’ দেওয়াও চলে। শুভ সরকার ও সৈকত সরকার—এই দুই ভাইয়ের কাছে বাবা দিবসের তাৎপর্যই আলাদা। শুধু এই বিশেষ দিন নয়, তিন বছর ধরে প্রতিদিনই বাবার জন্য ভালোবাসা নিয়ে দিনরাত করে যাচ্ছেন কাজ আর কাজ। কেননা, কর্কট রোগে আক্রান্ত বাবাকে ভালো রাখতে হবে। ধারাবাহিক চিকিৎসা করিয়ে যেতে হবে। তাই ২১ বছর বয়সী শুভ সরকার তিন বছর আগে শুরু করেছেন তথ্যপ্রযুক্তির ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১১ বছর বয়সী ছোট ভাই সৈকত সরকার।

গতকাল শনিবার রাজধানীর আজিমপুরে রুবেল মিয়ার বাসায় গিয়ে কথা হলো তাঁর দুই সন্তান শুভ ও সৈকতের সঙ্গে। রুবেল মিয়া জানান, ২০২০ সালে হঠাৎ ধরা পড়ল তিনি ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত। সরকারের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রুবেল মিয়া। ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসা করবেন কীভাবে?

বড় ছেলে শুভর বয়স তখন ১৮ বছর। রিপোর্ট দেখে বলেছিলেন, বাবা চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবাকে সুস্থ ও বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে নেমে যান শুভ। তখন শুভ আজিমপুরের রায়হান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র। এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এর আগে ইউটিউবে ভিডিও দেখে কম্পিউটার গ্রাফিকসের কাজ শিখেছেন। সেটা আরও ভালো করে শেখার জন্য ঢাকার ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটে ছয় মাসের মোশন গ্রাফিকস কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু বিধি বাম, ১৫ দিন ক্লাস হওয়ার পর এল করোনা মহামারি।

বাসায় বসে অনলাইনে ক্রিয়েটিভ আইটি থেকে মোশন গ্রাফিকসের ক্লাস শেষ করেন। একই সঙ্গে থ্রিডি অ্যানিমেশন শেখার চেষ্টা করতে থাকেন। ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার বিভিন্ন সাইটে (অনলাইন মার্কেটপ্লেস) কাজ শুরু করলেন। ছেলের আগ্রহ দেখে বাবা কষ্ট করে একটা কম্পিউটারও কিনে দিলেন।

এরপরই শুরু হলো মুক্ত পেশাজীবী হিসেবে শুভর কাজ করা। প্রথমে ফাইভআরে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করতে থাকেন শুভ। ধীরে ধীরে মোশন গ্রাফিকসের কাজও পেতে শুরু করলেন। কাজ বাড়তে থাকল। আয়ও বাড়তে থাকল। আর বাবার ক্যানসার চিকিৎসাও চালাতে লাগলেন ভালোভাবে।

বাবার সঙ্গে দুই ভাই শুভ ও সৈকত
প্রথম আলো

সহযোগিতার জন্য শুভর পাশে দাঁড়াল শিশু সৈকতও। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটে বড় ভাইয়ের কাজ দেখতে দেখতে সৈকতও এগিয়ে আসে শুভর পাশে। এখন দুই ভাই কাজ করছেন থ্রিডি অ্যানিমেশন ও প্রোডাক্ট অ্যানিমেশনের। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সৌদি আরব, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। নিজেরা একটি ডিজিটাল এজেন্সি করেছেন, যার নাম পিক্সিহেক্স। দুই ভাইয়ের সঙ্গে আছে আরও চারজন। মাসে শুভ-সৈকতের কাজ থেকে আয় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা।

বাবা রুবেল মিয়াও এখন প্রায় সুস্থ। তারপরও রোগটির নাম ক্যানসার। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দুই সন্তান ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয় থেকে বাবাকে ঈদুল আজহার পর বিদেশে নিয়ে যাবে চেকআপ করানোর জন্য। এসব কারণে রুবেল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা দিবস প্রতিদিনই হয়। করোনার সময় আমার ছোট ছোট দুই ছেলে আমাকে বাঁচানোর জন্য দিনরাত যে যুদ্ধ করেছে, তা ভুলতে পারি না।’

রুবেল মিয়া আরও বলেন, ‘আমি আমার বাবার জন্য যা করেছি, আমার ছেলে দুটি তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি আমার জন্য করছে। এখন আমি ভালো আছি। তারপরও ছেলে বলেছে ঈদের পর দেশের বাইরে নিয়ে যাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে। ২০২২ সালের মার্চ থেকে আমি নিয়মিত অফিস করা শুরু করেছি। সময়মতো চিকিৎসা শুরু না হলে সেটা হয়তো পারতাম না।’

শুভ সরকার (বাঁয়ে) ও সৈকত সরকার
প্রথম আলো

কথা হয় শুভ-সৈকতের মা সুলতানা রাজিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুভর বাবার ক্যানসার ধরা পড়ার প্রথম দিকে আত্মীয়স্বজনেরা খোঁজখবর নিতেন। একটা সময় আর কেউ যোগাযোগ করেন না। অনেক কাছের মানুষ দূরে চলে গেছেন। ফোনও কেউ ধরতেন না, যদি টাকা চাই। সময়টা ছিল অনেক কষ্টের। দুই ছেলে আমাদের সাহস দিত, “মা কিছু হবে না। আমরা আছি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সৈকত সরকার এখনো অনেক ছোট। কীভাবে ভাইয়ের কাজে সহায়তা করে জানতে চাইলে সে বলে, ‘ভাইয়া যখন ঘুমায়, তখন আমি তাঁর দেখানো কাজগুলো করে দিই। যদি কোনো ভুল থাকে, পরে আমাকে সেগুলো দেখিয়ে দেন।’

শুভ ও সৈকত দুই ভাই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন ভালোভাবেই। শুভ এখন ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে (সিএসই) তৃতীয় সেমিস্টারে পড়ছেন। আর সৈকত সরকার পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, আজিমপুরের রায়হান স্কুল অ্যান্ড কলেজে।

পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ তো চলছেই। এভাবে শুভ সরকার ও তার ভাই বাবা রুবেল মিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুভ সরকার যেহেতু অ্যানিমেশন, থ্রিডি গ্রাফিকস নিয়ে কাজ করেন, তাই তাঁর আয়টাও বেশ বড় অঙ্কের। বাবাকে বাঁচাতে যুদ্ধ করতে করতে হয়ে উঠেছেন সফল ফ্রিল্যান্সার। প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছেন বাবার জন্যই। শুভ বলেন, ‘কাল (আজ রোববার) বাবা দিবসে পুরো পরিবার বেড়াতে যাব বাবাকে নিয়ে। কেনাকাটাও করব বাবার পছন্দমতো।’