চার হাজার বছর পর দ্বিঘাত সমীকরণের নতুন সমাধান
দীর্ঘ চার হাজার বছর পর বীজগণিতের দ্বিঘাত সমীকরণের একটি সহজ সমাধান পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছেন মার্কিন গণিতবিদ, কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যুক্তরাষ্ট্র দলের দলনেতা পো শেন লো (Po-Shen Loh)। লো ইন্টারনেটে ব্যক্তিনির্ভর গণিত শেখার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত ওয়েবসাইট এক্সপি ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা।
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে, ব্যাবিলনে খাজনা হিসেবে শস্য প্রদানের হিসাব করতে গিয়ে দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের দরকার হয়। কৃষিজীবী ব্যাবিলনীয়দের খাজনা দিতে হতো শস্যে। নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দেওয়ার জন্য ঠিক কতটুকু জমিতে আবাদ বাড়ানো দরকার, সেটিই ছিল তাদের সমস্যা। বীজগণিতের ভাষায় এটি হলো ax2+bx+c=0 সমীকরণের সমাধান।
যেকোনো বীজগাণিতিক সমীকরণে কয়টি সমাধান থাকবে, তা নির্ভর করে ওই সমীকরণের অজানা রাশির ঘাতের ওপর। যেমন x-4=0 এই সমীকরণে x এর মান 4 এবং এই একটি মানই সমীকরণটির সমাধান। কিন্তু x2-4=0 এ সমীকরণে x এর মান 2 বা -2 এর দুটি মানের জন্যই সত্য। সে হিসাবে ax2+bx+c=0 এই সমীকরণেও x এর দুটি মান থাকবে। সেই চার হাজার বছর আগেই ব্যাবিলনীয়রা এই বীজগাণিতিক সমীকরণের সমাধান বের করেছেন, যা হলো
(যেকোনো বীজগণিতের বইয়ে এই সমাধানটি বিস্তারিত পাওয়া যাবে)
কয়েক দিন আগে, ৬ ডিসেম্বর, গণিতবিদ পো শেন লো তাঁর নতুন সমাধান পদ্ধতিটি প্রকাশ করেন তাঁর ওয়েবসাইটে। একই দিন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) টেকনোলজি রিভিউতে সেটি ছাপা হয়। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর এটি একটি গণিত সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। সমাধানটি এত সহজ এবং চমৎকার যে কয়েক দিন ধরে আমরা যারা ডাচ–বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসবের সঙ্গে জড়িত, তারা প্রায় মোহাবিষ্ট হয়ে এই সমাধান নিয়ে আলাপ করেছি। এর চেয়ে সুন্দর সমাধান আর কী হতে পারে!
আমার ভালো লাগার আরেকটি কারণ হলো পো শেন লো নিজে। পো শেন লোর সঙ্গে আমার পরিচয় আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের কোনো এক আসরে। তখন লো ছিলেন মার্কিন দলের উপদলনেতা। বাংলাদেশ দলের উপদলনেতা হিসেবে আমরা সব সময় একই হোটেল বা ক্যাম্পাসে থাকতাম। দেখা হলেই লো আমাদের দলের পারফরম্যান্স নিয়ে আলাপ করতেন, আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। আর একটা কাজ ছিল মার্কিন গণিত দল নির্বাচনের প্রশ্ন দিয়ে সহায়তা করা। এর মধ্যে লো হয়ে যান মার্কিন দলের দলনেতা। সেই থেকে আমার সঙ্গে খাতির কমে যায় কিন্তু বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য তাঁর চিন্তাটা অব্যাহত থাকে। গত বছর পো শেন লো বাংলাদেশে এসেছেন। সেই সময় বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেয় ফারদীম মুনির। সেই সময় আলাপকালে পো শেন লো বলেছেন, শিক্ষার্থীদের গণিতে আগ্রহী করার একটি বড় উদ্যোগ হবে প্রচলিত কঠিন বিষয়গুলোকে সহজ পদ্ধতিতে শেখানোর বুদ্ধি বের করা। আর চার হাজার বছর ধরে চলমান একটি সমস্যার সহজ সমাধান করে লো তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
অন্যান্য গাণিতিক আবিষ্কারের মতো লোর আবিষ্কৃত সমাধানটি খুবই সহজ ও সুন্দর। লো এমন একটি সাধারণ ধারণা ব্যবহার করেছেন, যা সবাইকে চমৎকৃত করেছে। দেখা যাক লোর সমাধান। লো ax2+bx+c=0 এই সমকীরণটিকে দুই পাশে a দিয়ে ভাগ করে পেয়েছেন x2+(b/a)x+(c/a)=0 যা কিনা নিম্নোক্ত আকারে লেখা যায়।
x2+Bx+C=0
এই সমীকরণের দুটি মূল যদি যথাক্রমে R এবং S হয়, তাহলে আমরা লিখতে পারি–
স্বভাবতই এই সমীকরণের বাম দিকের অংশ যদি 0 হয়, তাহলে x এর মান হয় R অথবা S হবে। ডান পক্ষকে একটু সাজিয়ে নিয়ে আমরা লিখতে পারি
এর মানে হলো সমীকরণের মূল দুটির যোগফল হলো -B এবং গুণফল হলো C। এরপরই লো লক্ষ করেছেন, দুটি সংখ্যার যোগফল যদি অপর একটি সংখ্যা হয়, তাহলে সংখ্যা দুটির প্রতিটি সেই যোগফলের অর্ধেক হবে অথবা একটি অর্ধেকের বেশি এবং অন্যটি অর্ধেকের কম হবে! অর্থাৎ আমাদের উদ্দিষ্ট দুটি মূলের গড় হবে –B/2। এখন আমরা যদি যেকোনো একটি ছোট সংখ্যা z নিই, তাহলে আমরা
মূল দুটিকে লিখতে পারি
এবং
তাহলে দুটি গুণ করে আমরা লিখতে পারি
সামান্য যোগ–বিয়োগ করলেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি z এর দুটি মান।
তার মানে হলো আমাদের দুটি মূল বা সমাধান হলো
এবং এটি খুবই সহজ। ব্যাবিলনীয়দের কঠিন সূত্র মুখস্থ না করে আমরা অতি সহজে এই সমাধান ব্যবহার করতে পারি।
লো তাঁর পদ্ধতির একটি উদাহরণ দিয়েছেন। ধরা যাক আমাদের x2 - 2x+4=0 –এই সমীকরণের মূল বের করতে হবে। সনাতন পদ্ধতিতে আমাদের a=1, b=-2 এবং c=4 ধরে সমাধান করতে হবে। কিন্তু লোর পদ্ধতিতে আমাদের দরকার শুধু z এর মান বের করা। যেহেতু মূল দুটির গুণফল C=4 কাজে আমরা লিখতে পারি (B=-2) :
কাজে আমাদের মূল দুটি হলো
এভাবে সহজেই দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধান বের করতে পারেন। পো শেন লো তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিও বার্তায় এ আবিষ্কারের অনুপ্রেরণার কথা জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য গণিতের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর একটি উদ্দেশ্য ছিল কিছু কিছু কঠিন বিষয়কে সহজ করা। আর সেটার সন্ধান করতে গিয়ে তিনি এই সমাধান খুঁজে পেয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর এই সমাধান কত দ্রুত বিশ্বব্যাপী গণিত শিক্ষার্থীদের দ্বিঘাত সমীকরণের মূল খোঁজার কঠিন সূত্র মুখস্থ করার হাত থেকে রক্ষা করবে। আমার নিজের আশঙ্কা, আমাদের দেশে অনেক পরীক্ষক এই নিয়মে পরীক্ষার খাতায় সমাধান করলে সেটি মেনে নিতে অনেক সময় নেবেন।