ফেসবুকে সত্যমিথ্যার দোলাচলে
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।...
কান নিয়ে গেছে চিলে, তারপর সেই চিলের পেছনে ছোটাছুটি, মিটিং মিছিল কত কী! শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় তার বিষদ বর্ণনাই রয়েছে।
এই সময়ে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে যা যা ঘটে বা ঘটে চলেছে, তার সঙ্গে বেশ প্রাসঙ্গিক চিলের পেছনে খামোখা ছোটার এই কবিতা। বরং এখন তা আরও ভয়ংকর। উড়ো খবরের পেছনে ছুটে শুধু পণ্ডশ্রম হয় না, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমাজের কোনো অংশের চরম ক্ষতি হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন সামাজিকতার সীমানা ছাড়িয়ে যায়।
একুশ শতকে এসে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব–নির্ভর যে ভার্চ্যুয়াল জগৎ, তাকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। তবে এ কথা তো ঠিক, যতই ‘ভার্চ্যুয়াল’ বলি এই ভার্চ্যুয়ালের পেছনে তো আসল মানুষ, বাস্তব জগৎটাই থাকে। শুধু ফেসবুকের ব্যবহারকারীই ২৩০ কোটির বেশি। তাই এর প্রভাব এতটাই যে গণমাধ্যম বলি আর সামাজিকতা—ফেসবুক এসবকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, কিন্তু সবকিছুতেই প্রভাব ফেলছে ফেসবুক। বিগত মার্কিন নির্বাচনে ফেসবুকের মাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারিত হয়েছে, সেই প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। সে জন্য মার্ক জাকারবার্গকে হাজিরা দিতে হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে—এ তো পুরোনো খবর। ভুয়া খবর ঠেকাতে ফেসবুকের নানা চেষ্টাও শুরু হয়েছে তার পর থেকে।
বাংলাদেশেও ফেসবুক কিংবা অনলাইন ভুয়া খবর ছড়ানোর বড় অস্ত্র। প্রবীণ অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানের মৃত্যুসংবাদ যে কত কতবার দেখা গেছে ফেসবুকের পোস্টে। মৃত্যুর আগেই নায়করাজ রাজ্জাকের শোকসংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে একাধিকবার। সেখান থেকে কোনো কোনো সময় এগুলো গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়।
সমাজ নিয়ে ভাবেন এমন একজন উন্নয়নকর্মী কথায় কথায় সেদিন বললেন, ফেসবুকের যে শক্তি, তা আমরা কাজে লাগাচ্ছি না। এর তো মূল ব্যবহার হওয়ার কথা মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগে, মিথস্ক্রিয়ায়। সেখানে কী খেলাম, কোথায় বেড়াতে গেলাম—সেসবই এখন বেশি দেখা যায়।
ব্যক্তিগত নানা আনন্দ উদ্যাপন, অনুভূতি কিংবা শোকের প্রকাশ তো নির্দোষ। কিন্তু ঘৃণা ছড়ায় এমন পোস্টও দেখা যায়। গুজব এমনিতেই ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ফেসবুক কিংবা অনলাইনে তা দাবানলের মতো। কিছুদিন আগের ভোলার ঘটনার কথা কিংবা কয়েক বছর আগে রামুর ঘটনার কথা মনে তো আছে সবারই। এ রকম ঘটনা সামাল দেওয়াও তো কঠিন। অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সেটা থেকে উসকানিমূলক ছবি, পোস্ট কিংবা ভিডিও ছড়ানো যায়—এ কথা অনেকেই আমরা জানি। কিন্তু ফেসবুকে সেসব দেখে অনেকেই আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাই। টপাটপ শেয়ার করে ফেলি।
সেদিন একজন বললেন, কোনো খবরই যাচাই না করে শেয়ার করা উচিত না। অনলাইনে তো নয়ই। কেননা প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে এর অপব্যবহার করা যায় সহজেই। এখন প্রযুক্তি যে পর্যায়ে তাতে ছবি বা ভিডিও বিকৃত করা, চাঁদের মধ্যে কারও মুখাবয়ব জুড়ে দেওয়া কোনো ব্যাপার না। এমনকি মূলধারার গণমাধ্যমের লেখাও এদিক–ওদিক করে সেই মাধ্যমের লোগো বসিয়ে ছড়িয়ে দেওয়াই সহজ। পরে হয়তো প্রমাণিত হবে, সেটি ভুয়া বা ফেক ছিল। সাইবার আইনে মামলা–মোকদ্দমাও হয়তো হবে। তাতে কী, ক্ষতি যা হওয়ার তা হবেই।
ব্যবহারকারীর দায়িত্ব তো আছেই। কোটি কোটি ব্যবহারকারীর সবাই তো আর প্রযুক্তিতে দক্ষ না, কোনটা ভুয়া কোনটা আসল, তা–ও অনেকে বোঝেন না। ভুয়া খবর, ছবি বা ভিডিওকে বিশ্বাস করেন, শেয়ার করে দেন নিজের ফেসবুক প্রোফাইল বা পেজ থেকে। কিন্তু অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকেও দেখা যায় মাঝে মাঝে এমন কিছু পোস্ট দিতে বা শেয়ার করতে, যার কোনো সত্যতা নেই।
আমরা এখনো ফেসবুকের মতো বিশাল–বিপুল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার যোগ্য হইনি। এমন কথা শোনা যায় প্রায়ই। কিছু ঘটনার পর তা মনে হতেই পারে। ফেসবুকের এমন অপব্যবহার সব জায়গাতেই আছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের হত্যাকাণ্ড ফেসবুকে লাইভ করেছিল হত্যাকারী। বীভৎস, উদ্ভট, বানোয়াট নানা কিছুই দেখা যায় ফেসবুকে। সেসব ক্ষেত্রে স্থান–কাল–পাত্র ব্যাপার না, ব্যাপার হলো অপরাধমূলক মানসিকতা।
অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হয়। নিজের অ্যাকাউন্ট হাতছাড়া হলে করার কিছুই থাকে না। হ্যাকার যত কম সময়ই পাক না কেন, তার উদ্দেশ্য হাসিল করবেই। তাই ফেসবুক বা অন্য যেকোনো ওয়েবসাইটে প্রাইভেসি সেটিংসটা ঠিক করে নিন। পাসওয়ার্ড দিন নিয়ম মেনে। বদলে নিন মাঝেমধ্যে।
অনেকের অনেক বিষয়ে আগ্রহ আছে, আছে দুর্বলতাও। সেসবের সঙ্গে কোনো পোস্ট মিলে গেলে, সেটা ছড়িয়ে দেন সত্যমিথ্যা না জেনেই। বিজ্ঞজনের কথা হলো, এখানেই আসল ভয়। ভুয়া খবরের নীল সাপেরা ফেসবুকে যেন ফেলিছে নিশ্বাস।
চিলের পেছনে না ছুটে আগে নিজের কানে হাত দিয়ে দেখতে হবে, সেটা জায়গামতো আছে কি না, ছোট ছেলেটি বলার আগেই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।