এমন একটা ব্যবস্থার কথা কল্পনা করা যাক, যেখানে প্রতিদিনের মতো শিক্ষক ক্লাসে এসে রোল নম্বর ধরে উপস্থিতি যাচাই করছেন না, সিসিটিভি ক্যামেরার ছবি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুঝে ফেলা সম্ভব হচ্ছে কে ক্লাসে আছে, কে নেই। আবার শহর থেকে অনেক দূরের মফস্বল শহরের একজন কিশোরকে আক্ষেপ করতে হচ্ছে না জাদুঘরের ভেতরটা দেখতে কেমন তা দেখার সুযোগ না পাওয়ার কারণে, বরং মফস্বল শহরে বসেই ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে ডানে–বামে মাউস ঘুরিয়েই দেখে নেওয়া যাচ্ছে জাদুঘরের ভেতর–বাহির।
আরও কল্পনা করা যাক, মধ্যরাতে কিংবা ছুটির কারণে গ্রাহক সেবা প্রতিনিধি না থাকায় ফোনে কত টাকা আছে, তা জানা কিংবা টেলিমেডিসিন সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে না একজনকেও। মিনিটের পর মিনিট লাইন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না গ্রাহক সেবা কর্মী ব্যস্ত থাকার কারণে; বরং ২৪ ঘণ্টাই কোনো ধরনের অপেক্ষা ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে গ্রাহক সেবা।
সত্যি বলতে কি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, সহজাত ভাষা বা ছবি–প্রক্রিয়া (ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, ইমেইজ প্রসেসিং) করার প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে এসব ব্যবস্থা এখন রূপ নিয়েছে বাস্তবতায়। নামীদামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে অনেক উদ্যোক্তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পুঁজি করে নেমে পড়েছেন নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী?
সহজ ভাষায় বললে, যন্ত্র যখন বুদ্ধিমান মানুষের মতো কাজ করে বা প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। স্বাভাবিকভাবে যেসব বিষয়ের জন্য মানুষের প্রয়োজন হয়, যেমন কারও চেহারা দেখে বা কণ্ঠ শুনে তাকে চিনতে পারা, বিশেষজ্ঞের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বদৌলতে এখন যন্ত্রের মাধ্যমে সেগুলো করা সম্ভব হয়ে উঠছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধরে যেসব উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ এবং প্রতিনিয়ত নতুন উদ্যোক্তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সঠিকভাবে ব্যবহার করে নানা রকম কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কিছু ব্যবহারের কথা বলা যায়, যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে নতুন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া যায়।
চ্যাট বট: আমাদের নিত্যদিনকার কিছু সাধারণ ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যাক। আমরা রেস্তোরাঁয় ফোন করে সেটি কয়টা পর্যন্ত খোলা, খাবারের মেনু কী জানতে চাই কিংবা আসন সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। চিকিৎসকের সাক্ষাৎকারের জন্য তিনি আছেন কি না, চেম্বারে কখন আসবেন অথবা নির্দিষ্ট কোনো অসুখের জন্য কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে হবে, সে তথ্যও জানতে চাই। প্রতিবছর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে লাখ লাখ পরীক্ষার্থী টাকা খরচ করে এসএমএস করে ফলাফল পেতে চাই। এই সব সেবা ‘চ্যাট বট’–এর মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। ফেসবুক বা অন্য যেকোনো মেসেঞ্জারে চ্যাট বট তৈরি করে ফেললে ব্যবহারকারীর প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে কোনো মানুষের ফোন রিসিভ করে বা অনলাইনে বসে থেকে উত্তরগুলো দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
গ্রাহক সেবা: প্রতিদিন অসংখ্য লোক গ্রাহক সেবা পাওয়ার জন্য ফোন করে থাকেন মোবাইল অপারেটর, ব্যাংক, বিমা, বিভিন্ন করপোরেট অফিসের গ্রাহক সেবা প্রতিনিধির কাছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রশ্নগুলো ঘুরে–ফিরে একই ধরনের। যেমন ‘আমার মোবাইল ব্যালেন্স কত’, ‘আমার অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স কত’, ‘আমার বিল জমা দেওয়ার শেষ সময় কবে’ ইত্যাদি। সমস্যা হলো, অনেক সময় গ্রাহকদের ফোন করে অপেক্ষা করে থাকতে হয়। কেবল কোনো প্রতিনিধি ফাঁকা থাকলেই তিনি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন। অনেক অফিসে রাতে কোনো প্রতিনিধিই থাকেন না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহক সেবা প্রতিনিধির বদলে সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই সেবাগুলো দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে গতানুগতিক ধারার সাধারণ প্রশ্নের জন্য এটি বেশ ভালোভাবেই কাজ করবে।
রেকমেন্ডেশন সিস্টেম: ধরা যাক, আপনি কোনো রেস্তোরাঁয় গেলেন, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছেন না কী খাবার অর্ডার করবেন। সে ক্ষেত্রে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো অ্যাপ বা সেবা ওই রেস্তোরাঁয় থাকে, তবে কিছু প্রশ্ন করে সেই অ্যাপই আপনাকে খাবার পছন্দ করতে সাহায্য করতে পারে। আমাদের দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ই-কমার্স বাণিজ্য। সেখানে ক্রেতা যখন কোনো পণ্য কেনেন, তার ওপর ভিত্তি করে নতুন পণ্য ক্রয়ের জন্য সুপারিশ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো ক্রেতা তথ্য এবং আগেরকার পণ্য কেনার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে, এমনকি অন্য ক্রেতাদের সঙ্গে মিল-অমিল খুঁজে দেখেও নতুন পণ্য কেনার প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। আমাজন, নেটফ্লিক্স, ইউটিউবের পরামর্শ বা রেকমেন্ডেশনগুলো এভাবেই কাজ করে থাকে।
নোটিফিকেশন সেবা: আপনি হয়তো কোনো নায়ক বা নায়িকার ছবি দেখতে পছন্দ করেন। কিন্তু আপনার হাতে সময় নেই যে প্রতি সপ্তাহে খুঁজে খুঁজে বের করা নতুন কোনো অ্যাকশন সিনেমা এল কি না। আবার বেড়াতে যেতে চান, কিন্তু আপনি জানেন না কোন সময় হোটেলের ভাড়া বা বিমানের টিকিটের দামে ছাড় থাকবে। ওদিকে, প্রতিদিন তাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে বা ফোন করে করে এই তথ্যগুলো নেওয়াটাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যদি এমন একটা ব্যবস্থা থাকে, যেটি সিনেমা হলে আপনার পছন্দের নায়ক-নায়িকার সিনেমা আসার সঙ্গে সঙ্গে কিংবা হোটেল না বিমান সংস্থা টিকিটের দামে ছাড় দেওয়ামাত্রই সে তথ্য আপনি ই–মেইল বা এসএমএসে পেয়ে যাবেন। আপনার সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হলো। অর্থাৎ, যে কাজটি হয়তো আপনার ব্যক্তিগত সহকারী বা ম্যানেজার করতেন, সেটি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একটি প্রোগ্রামই করে দিতে পারবে।
আরও চিন্তা করা যাক, আপনি গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছেন। যাওয়ার পথে কোনো ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হবে, অথবা খাবার দোকান থেকে খাবার কিনতে হবে। গাড়িতে সেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় যদি আপনাকে নোটিফিকেশন দিয়ে জানানো হয় যে এখানে একটি ফার্মেসি বা রেস্তোরাঁ আছে, তাহলে আপনার জন্য দোকানগুলো খুঁজে পাওয়া যেমনটা সহজ হবে, তেমনটা যাত্রাকালে উদ্বিগ্ন থাকার হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে।
রোবট ও ড্রোন
রোবট এবং ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশ এগিয়ে গেলেও ছোট ছোট কিছু বিশেষায়িত কাজে এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, দুর্গম এলাকায় জরুরি সময়ে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হলে ড্রোনের মাধ্যমে সেই রক্ত সরবরাহ করা যেতে পারে, বাঁচানো যেতে পারে মহামূল্যবান প্রাণ। তা ছাড়া যেসব জায়গায় যাওয়া মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে ছোট ছোট রোবট–জাতীয় যন্ত্রাংশ পাঠানো যেতে পারে। তবে, এ ক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যে রোবট বা ড্রোন ব্যবহার হবে, সেটির ওপর ভিত্তি করে নকশা ও কারিগরি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
রোগনির্ণয়: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্যানসার শনাক্তকরণের মতো কাজেও বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে। ছবি প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতি ছাড়াই মেডিকেল ইমেজ (রেডিওলজি) বিশ্লেষণ করে অনেক ক্ষেত্রেই বলে দেওয়া সম্ভব বিশেষ কোনো সমস্যার উপস্থিতি আছে কী নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রিপোর্টের ফলাফল বিশ্লেষণ করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বলা সম্ভব রোগী কোন ধরনের সমস্যায় ভুগতে পারে বা কী ধরনের চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। এই ধরনের সিস্টেমগুলোকে সাধারণত এক্সপার্ট সিস্টেম বলা হয়ে থাকে।
বাস্তবের মতো: এমন কোনো অ্যাপ্লিকেশন যদি বানানো যায় যে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনেই আপনার বাসা থেকে গন্তব্যে যাওয়ার পথটুকু সেটি সিনেমার মতো করে ঘুরিয়ে দেখাতে পারে, তবে তা বাস্তবে একবার সেই গন্তব্যে ঘুরিয়ে আনার মতোই হলো।
আপনার হয়তো শাড়ি, গয়না, রোদচশমা বা ঘড়ি কেনা প্রয়োজন। কিন্তু দোকানে গিয়ে ঘুরে দেখে, ট্রায়াল দিয়ে কেনার সময় আপনার নেই। এখন যদি এমন একটা ব্যবস্থা থাকে যে আপনি ওয়েব ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন, একটা একটা করে শাড়ি-গয়না পছন্দ করলেন। আর অমনি কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠল সেই শাড়ি-গয়না পরা আপনাকে কেমন দেখাল। শাড়ির রং কিংবা ঘড়ির ডিজাইন আপনার সঙ্গে কতটা মানানসই হলো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এর সবকিছুই বর্তমানে সম্ভব হয়ে উঠছে।
এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ধারণার, নতুন নতুন উদ্যোগের। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনো জাদুর বাক্স নয়; উপযুক্ত বিচার-বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরই কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–নির্ভর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। মানুষের সহজাত বুদ্ধিমত্তার জুতসই ব্যবহারের মাধ্যমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যকরী ব্যবহার সম্ভব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়