সুখবর ফ্রিল্যান্সিং
দিন বদলাচ্ছে ফ্রিল্যান্সারদের
এখন দেশে সাড়ে ৬ লাখ থেকে ১০ লাখ তরুণ ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করেন। ঘরে বসেই আয় করেন ডলার। অন্যদেরও সুযোগ করে দিচ্ছেন।
বয়স বড়জোর ২৩-২৪। পরিপাটি ঝকঝকে চেহারা। গায়ে বিশ্বখ্যাত কোনো ব্র্যান্ডের শার্ট-জিনস, পায়ে নামী ব্র্যান্ডের কেডস, কাঁধের ব্যাগে ল্যাপটপ-অ্যাপলের ম্যাকবুক। এর সবই নিজের আয়ে কেনা। এই বয়সে যাঁর লেখাপড়া শেষ দিকে থাকার কথা বা চাকরি খোঁজার কথা, তিনি কীভাবে এমন স্বাবলম্বী জীবনযাপন করছেন? এই তরুণ হচ্ছেন ফ্রিল্যান্সার। এখন তাঁর মতো অনেক তরুণ দেশে বসে ডলারে আয় করেন। অনেকের মাসিক আয় হাজার ডলার বা তার বেশি।
ফ্রিল্যান্সারের বাংলা করা যায় মুক্ত পেশাজীবী। নয়টা-পাঁচটা চাকরির ঘেরাটোপে আবদ্ধ নন তাঁরা। বাসা কিংবা যেকোনো স্থানে বসেই কাজ করতে পারেন। লাগবে নিজের দক্ষতা, বিদ্যুৎ আর গতিশীল ইন্টারনেট-সংযোগ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মী নিলে খরচ বেশি হয়। অনেক সময় চাহিদামতো এত কর্মী পাওয়া যায় না।
তারা তখন বাইরে থেকে (আউটসোর্সিং) নির্দিষ্ট কাজটি করিয়ে নেন। এতে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির যেমন অর্থ সাশ্রয় হয়, তেমনি যেকোনো স্থান থেকে কাজটি করে ওই ব্যক্তিও আয় করেন। বেশির ভাগ কাজ মেলে নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইটে। তথ্যপ্রযুক্তির ভাষায় এগুলো ‘অনলাইন মার্কেটপ্লেস’ (অনলাইন কাজের বাজার)। দেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে।
সফটওয়্যার তৈরির প্রতিষ্ঠান টেকনোবিডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ ইমরাউল কায়ীশ একসময়ের সফল ফ্রিল্যান্সার। তিনি বলেন, ২০০৫-০৬ সাল থেকে মূলত দেশে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ আসা শুরু হয়। তরুণেরাই এ কাজে অগ্রণী। ফ্রিল্যান্সিংকে জনপ্রিয় করতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের ‘বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড’-এর অবদান রয়েছে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে লাখো তরুণ, আয় কত
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ জানালেন, দেশে এখন সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তাঁদের সব মিলিয়ে বার্ষিক আয় প্রায় ১০০ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (ডলার ১০৬ টাকা ধরে)। ২০১৪ সাল থেকে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫৩ হাজার তরুণকে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান তানজিবা রহমান বলেন, সাড়ে ছয় লাখের হিসাবটা আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেস ধরে। বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টি মার্কেটপ্লেসে কাজ করা হয়। সেগুলো হিসাব করলে এই সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। এর ৫৫ শতাংশেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছর। তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো কম।
তানজিবা রহমান বলছেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষে ভারত। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। তবে আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তানজিবা রহমান বলেন, ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার ফ্রিল্যান্সারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। এসব কার্ডধারী ব্যাংকঋণ সুবিধা পাবেন। ব্যাংকের মাধ্যমে বাইরে থেকে আয়ের অর্থ আনলে ৪ শতাংশ প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে।
যেভাবে শিখতে হবে
সফল ও অভিজ্ঞ ফ্রিল্যান্সার ঢাকার তৌহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সবার আগে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়টা বুঝতে হবে। এরপর তথ্যপ্রযুক্তির একটি বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। ভালো হয় প্রথমে কোথাও চাকরি করা কিংবা সফল কোনো ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে থেকে কাজ করা। এসব কাজের উল্লেখ করে মার্কেটপ্লেসে ভালো একটা পোর্টফোলিও তৈরি করে কাজ নিতে হবে। সময়মতো কাজটি করে দিতে হবে।
করোনা মহামারির কারণে চাকরির বাজার ছোট হলেও ফ্রিল্যান্সিং কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে বলে জানান তানজিবা রহমান। এখন ডিজিটাল বিপণন, এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন), গ্রাফিক ডিজাইন ও লোগো তৈরি, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কাজের চাহিদা বেশি। এ ছাড়া কনটেন্ট রাইটিং (মূলত পণ্য বা সেবার বর্ণনা বা প্রচারণামূলক লেখা), মডার্ন ফটোগ্রাফি, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও হিসাবরক্ষণ বিষয়ের চাহিদা রয়েছে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে দুভাবে আয় হয়। একটি অ্যাকটিভ আর্নিং। এটি হচ্ছে সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে কাজ করে আয় করা। আরেকটি প্যাসিভ বা পরোক্ষ আয়। এটি হচ্ছে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ করে আয় করা।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির তথ্যমতে, বাংলাদেশে জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস হচ্ছে আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডটকম, ফাইভআর, গুরু ডটকম, টপটাল, পিপলপারআওয়ার ইত্যাদি। মার্কেটপ্লেসে কাজ পেতে পারিশ্রমিক ও সময় জানাতে হয় (বিড করা)। কাজদাতা পারিশ্রমিক ও পোর্টফোলিও দেখে যোগ্য ব্যক্তিদের কাজ দেন।
কাজের সামাজিক স্বীকৃতি
এখন অবস্থার উন্নতি হলেও দু-তিন বছর আগেও ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে দেশের মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। ‘রাত জাগে, সারা দিন কম্পিউটার নিয়ে থাকে, কী যে করে, এটা তো কোনো চাকরি বা স্থায়ী কিছু নয়, এর কাছে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যাবে না’—এমন কথা শুনতে হয়েছে অনেক ফ্রিল্যান্সারকে। তবে এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তবে ফ্রিল্যান্সারদের কাজের সামাজিক স্বীকৃতি বাড়লেও পথ এখনো অনেক দূর। বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ মনে করেন, ‘ফ্রিল্যান্সিংয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। এখন ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা বেশি, কিন্তু ১০ শতাংশ ভালো আয় করেন। আসলে তথ্যপ্রযুক্তির নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। ফ্রিল্যান্সার হতে হলে নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতার পাশাপাশি যোগাযোগেও দক্ষ হতে হবে।
ফ্রিল্যান্সার তৌহিদুর মনে করেন, উদ্যোগ, ব্যক্তিগত আয় বাড়লেও ভালো মানের প্রশিক্ষণের সুবিধা নেই।
চট্টগ্রামের আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান এক্সপোনেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, ‘আমাদের আরও এগিয়ে যাওয় উচিত ছিল। দেশের আইসিটি শিল্প খাত থেকে কোনো দিকনির্দেশনা ফ্রিল্যান্সাররা পান না। কোন বিষয়ের চাহিদা ভবিষ্যতে বাড়বে কিংবা কিসে দক্ষ হতে হবে—সেই পথনির্দেশনা আমরা পাই না।’
আবুল কাশেম বলেন, ‘ভারতে অনেক বড় বাজার। এমনকি পাকিস্তানেও একজন ফ্রিল্যান্সার বছরে ১ লাখ ডলার আয় করেন। সেখানে আমাদের কারও বার্ষিক ১০ হাজার ডলার আয় হলেই খুশি। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আইসিটি শিল্প খাত থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত ও দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।’
সামাজিক দায়িত্বও পালন করেন
ফ্রিল্যান্সারদের কাজকর্মে একটা বিষয় চোখে পড়ে। একা একা শুরু করে যখন সফল হন, তিনি আশপাশের তরুণদের সম্পৃক্ত করেন এই কাজে। তাঁদের আয়ের পথ তৈরি করে দেন।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গারো তরুণ সুবীর নকরেক সেই বনাঞ্চল থেকেই ফ্রিল্যান্সিং করে সফল হয়েছেন। এরপর তিনি আইটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে আশপাশের গারো তরুণদের শিখিয়েছেন। সব জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ হাজার তরুণকে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন।
আবার কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিধারী শেরপুরের মিনহাজ নিজে সফল হয়ে মাদ্রাসার ৭০০ ছাত্রকে ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়েছেন। ক্যানসারে আক্রান্ত বাবাকে বাঁচাতে ত্রিমাত্রিক গ্রাফিকস ও অ্যানিমেশন শিখে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিলেন ঢাকার শুভ সরকার। এখন তাঁর বাবা সুস্থ আর তিনি সফল ফ্রিল্যান্সার।