অনলাইন কেনাকাটায় লোভে পড়বেন না
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ই–কমার্স সাইটের প্রতারণা এবং ক্রেতাদের টাকা আটকে যাওয়ার ঘটনায় অনলাইন কেনাকাটার বিষয়ে অনেকের মধ্যেই আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তবে অনলাইন কেনাকাটা এ সময়ে সহজ ও কার্যকর এক বিষয়। ক্রেতারা সতর্ক থাকলে নিরাপদে অনলাইন কেনাকাটা করতে পারেন। লিখেছেন এ কে এম ফাহিম মাশরুর
ই-কমার্স খাত জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের দেশে কমপক্ষে একবার অনলাইন কেনাকাটা করা ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এ সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার তুলনায় ২ শতাংশের কম। ভারত ও চীনে এ হার যথাক্রমে ২০ ও ৫০ শতাংশের বেশি। আমাদের দেশে অনলাইনে ক্রেতার সংখ্যা কম হলেও ভবিষ্যতে তা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে নিশ্চিত।
অনলাইন কেনাকাটা নিয়ে অনেকেরই বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে মানহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য সরবরাহ, লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা, নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে পণ্য সরবরাহ করা অন্যতম। আবার অনেক সময় সময়মতো পণ্য সরবরাহ করলেও পণ্য গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেন অনেক ক্রেতা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণার ঘটনা ঘটলে শুধু ক্রেতারাই নয়, পুরো ই-কমার্স খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকলে নিরাপদে অনলাইনে কেনাকাটা করা সম্ভব।
লোভে পড়ে পণ্যের অর্ডার না দেওয়া
লোভে পড়ে অনলাইন থেকে পণ্য কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকেই। কেউ নিম্নমানের পণ্য পেয়েছেন, কেউ আবার পণ্য তো দূরের কথা, টাকাও ফেরত পাননি। ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে অনেক ই-কমার্স সাইটই বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রির লোভনীয় অফার দিয়ে থাকে। লোভের বশবর্তী হয়ে প্রয়োজন না থাকলেও পণ্য কেনার অর্ডার দেন অনেকে। উদ্দেশ্য, পণ্য হাতে পেয়ে সেগুলো বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করা যাবে।
ভুল, সবই ভুল। ক্রেতাদের বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতেই সাধারণত এ ধরনের অফার দেওয়া হয়ে থাকে। ক্রেতাদের বুঝতে হবে, উৎপাদকের বা পরিবেশকের চেয়ে কম দামে কারও পক্ষে ভালো মানের পণ্য বিক্রি করা সম্ভব নয়। ফলে ই-কমার্স সাইটগুলোর পক্ষেও অন্য প্রতিষ্ঠানের তৈরি পণ্য অর্ধেক দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। অনেক সময় প্রচারণার কৌশল হিসেবে ছাড় দেওয়া হলেও এর পরিমাণ খুব বেশি হয় না। তাই অনলাইনে পণ্য েনার সময় কোনোমতেই বেশি ছাড়ের লোভে পড়ে পণ্যের অর্ডার দেওয়া ঠিক নয়।
পণ্য হাতে পেয়ে মূল্য পরিশোধ
অনলাইনে পণ্য কেনাকাটায় সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হলো পণ্য হাতে পেয়ে মূল্য পরিশোধ করা, যা ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে পণ্যের মূল্য অগ্রিম দিতে হয় না। ফলে প্রতারণার কোনো আশঙ্কা থাকে না। শুধু তা–ই নয়, বিক্রেতার সরবরাহ করা পণ্যের মান যাচাইয়েরও সুযোগ মিলে থাকে। আর তাই ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য কেনার চেষ্টা করতে হবে।
অগ্রিম মূল্য পরিশোধে সতর্কতা
পণ্য হাতে পাওয়ার আগেই অনেক ই-কমার্স সাইট ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের মূল্য (পুরো বা আংশিক) অগ্রিম নেন। আমাদের দেশে অনলাইন কেনাকাটায় সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা এখানেই ঘটে। অনেকেই মুঠোফোনের বিভিন্ন আর্থিক সেবার মাধ্যমে পণ্যের দাম অগ্রিম পরিশোধ করেন। অগ্রিম যদি দিতেই হয় তবে ক্রেতাদের অর্থ স্থানান্তরের বদলে সরকার স্বীকৃত বিভিন্ন পেমেন্ট অপশন ব্যবহার করতে হবে। কারণ, পেমেন্ট অপশনের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করার পর কোনো সমস্যা হলে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, ভোক্তা অধিকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ সেলে অভিযোগ করা যায়। কিন্তু আপনি যদি পেমেন্ট অপশনের বাইরে অন্য কোনো মাধ্যমে অর্থ পাঠিয়ে থাকেন তবে অভিযোগ করেও লাভ হবে না। কারণ, প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ বিক্রেতারই কোনো ঠিকানা বা নিবন্ধন নম্বর থাকে না।
অপরিচিত সাইট বা ফেসবুক পেজ নয়
নতুন কোনো ফেসবুক পেজ বা ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কেনার সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের অফারগুলো ভালোভাবে যাচাই করে ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ সেবার মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। পণ্য হাতে না পেয়ে মূল পরিশোধ করা থেকে বিরত থাকুন।
পণ্যের পর্যালোচনা
বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে পণ্য কেনার সময় পণ্যের মান সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির মতামত ও অভিজ্ঞতা জানার সুযোগ মিলে থাকে। ফলে কেনার আগেই আপনার পছন্দের পণ্যের মান এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিতে পারবেন।
অভিযোগ জানাবেন যেভাবে
অনলাইনে মূল্য পরিশোধ করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য বুঝে না পেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সেবাকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। গ্রাহক সেবাকেন্দ্র না থাকলে বা সমাধানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেলে ক্রেতাদের দ্রুত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স অভিযোগকেন্দ্র বা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ বা মামলা করতে হবে।
গত বছর যে নতুন ডিজিটাল কমার্স নির্দেশনা প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখানে অর্থ পরিশোধের পাঁচ দিনের মধ্যেই ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। ফলে অর্থ পরিশোধের পাঁচ দিন পরও পণ্য বুঝে না পেলে যেকোনো ব্যক্তি অভিযোগ বা মামলা করতে পারবেন। প্রচারণায় ব্যবহৃত ছবির সঙ্গে সরবরাহ করা পণ্যের মিল না থাকলেও অভিযোগ বা মামলা করতে পারবেন ক্রেতারা।
লেখক: বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা