সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকনির্ভর উদ্যোক্তা জেবিন সুলতানা। নিজে নকশা করে বিছানার চাদর, ঘরের পর্দা ও পোশাক বানিয়ে বিক্রি করেন ফেসবুক পেজে। পেজটির নাম জারা ফ্যাশন। বেশির ভাগ পোশাকের প্রচারণা চালান ফেসবুক লাইভ ভিডিও করে। এমনিতে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হতো জেবিনের পেজ থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১২–১৩ দিন ধরে একেবারেই বন্ধ বেচাকেনা। কারণ ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ ছিল দেশে। গতকাল বুধবার থেকে আবার ফেসবুক চালু হলেও বিক্রি শুরু হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে জেবিন সুলতানা জানান, ‘ইন্টারনেটের গতি এত ধীর যে ফেসবুকে লাইভ করা যায় না। এমন বিক্রিশূন্য অবস্থা আরও কত দিন যাবে বুঝতে পারছি না।’
উদ্যোক্তা জেবিন সুলতানার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা সরল নয়। তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে। সবকিছু একাই সামলাতে হয়। শুরুর দিনগুলো এমন ছিল—ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যেতাম; কিন্তু সঙ্গে থাকত একটা কাপড়ের ব্যাগ। স্কুলের সামনে অনেক মা থাকতেন, আমি তাঁদের কাছে পোশাক বিক্রি করতাম। এর পরই ২০২০ সালে শুরু হলো করোনা মহামারি। তখন সরাসরি বিক্রি বন্ধ হয়ে গেল।’
করোনাকালে বিভিন্ন ফেসবুকের গ্রুপে যুক্ত হন জেবিন। বিভিন্ন পরামর্শ পান সেখান থেকে। ফেসবুকে তাঁর প্রোফাইল ছিল; কিন্তু কোনো পেজ ছিল না। পরিচিত একজনের সাহায্যে ফেসবুকে পেজ খোলেন তিনি। নিজের ডাকনামে পেজের নাম দিলেন জারা ফ্যাশন। তিনি বলেন, ‘ধীরে ধীরে আমার ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। ফেসবুকের মাধ্যমেই বিক্রি হয়। ছোট একটা কারখানাও চালু করলাম। চার–পাঁচজন কর্মী নিয়ে ভালোই চলছিল।’
এবার দেশে যখন হঠাৎ ইন্টারনেটসহ ফেসবুক বন্ধ করা হয়, তখন বড় সমস্যায় পড়ে গেলেন জেবিন সুলতানা। তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে যা বিক্রি হয়, সেখানে যে খুব বেশি লাভ হয়, তা নয়। বেশিসংখ্যক পোশাক বিক্রি হলেই তবেই ভালো একটা লাভের মুখ দেখি। হঠাৎ ছন্দপতনে এতটাই পিছিয়ে পড়েছি যে এখান থেকে উঠে দাঁড়ানো কষ্টকর হবে। ফেসবুক খুলেছে; কিন্তু ইন্টারনেট দুর্বল। লাইভে আসতে পারি না। কোনো পোস্ট দিতে গেলে সময় লাগে।’
ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ, কারখানার ভাড়া ও পাঁচ কর্মীর বেতন—সব মিলিয়ে প্রতিমাসে যে খরচ রয়েছে, প্রতিদিন পোশাক বিক্রি না হলে জেবিনের তা সামলানো সম্ভব নয়। ৫ কর্মীর বেতন ৫০ হাজার টাকা। জেবিন বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। কারণ লাভটা তখনই হয়, যখন অনেক পণ্য বিক্রি করতে পারি। এখন বিক্রি শূন্যের কোঠায়। ব্যবসার বিপরীতে আমার ব্যাংকঋণ রয়েছে, সেটির কিস্তির চাপও আছে। এখন বারবার মনে হচ্ছে, আবার কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে আবার রাস্তায় নামি।’ জেবিনের মেয়ে নাবিলা এবারের এইচএইচসি পরীক্ষার্থী ও ছেলে সোলাইমান হোসেন পড়ে নবম শ্রেণিতে।
ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) ট্রাস্টের সভাপতি ও ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সাড়ে চার লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ উদ্যোক্তাকে আবার প্রায় শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। তাদের ঘুরে দাঁড়াতে ন্যূনতম ছয় মাস লাগবে। আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে একটা প্ল্যাটফর্মে আনার। সেটি হলো উই হাটবাজার। এখানে সবাইকে যুক্ত করার একটা উদ্যোগ নিয়েছি।’
বাংলাদেশে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফেসবুকভিত্তিক (এফ-কমার্স) উদ্যোক্তারা। ২৩ জুলাই রাতে দেশে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড সেবা এবং গত রোববার বেলা তিনটা থেকে মুঠোফোনে ফোর–জি ইন্টারনেট চালু হলেও বন্ধ ছিল ফেসবুকের ব্যবহার। গত ৩১ জুলাই দুপুরে ফেসবুক খুলে দেওয়া হয়।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার ৩১ জুলাই একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, গত ১৩ দিনে এই খাতে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, প্রতিদিন তার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে এই ব্যবসা পুরোই বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ইন্টারনেট চালু থাকলেও গতি কম থাকায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বন্ধ থাকার কারণে এখনো সংকট কেটে ওঠেনি। এ ছাড়া কারফিউ ও নিরাপত্তাঝুঁকিসহ বিভিন্ন কারণে ই-কমার্স খাতের ৯৫ শতাংশ লেনদেন এখনো বন্ধ রয়েছে।
প্রতিদিনের বেচাকেনা না হওয়ার কারণে দৈনিক ১২০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। প্রথম ১০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে একটা বড় অংশ রয়েছে এফ–কমার্স উদ্যোক্তাদের, যার পরিমাণ নূ৵নতম ৬০০ কোটি টাকা, ই-কমার্স লজিস্টিকসে এর পরিমাণ হতে পারে অন্তত ১০০ কোটি টাকা, ই-ট্যুরিজমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তা ছাড়া অনলাইন শপ, মার্কেটপ্লেস, সার্ভিস পোর্টাল, ই-লার্নিং ও ডিজিটাল প্রোডাক্টস রয়েছে। গত ১৩ দিনে মোট ক্ষতি ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বেশি।