ইন্টারনেট–সেবায় বৈষ্যম্য দূর করতে হবে  

‘ব্যান্ডউইডথ ও ইন্টারনেটের বৈষম্যমূলক বাজার ব্যবস্থাপনা নিরসনে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারাসংগৃহীত

ট্যারিফ অর্থাৎ শুল্কের নামে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ইন্টারেনট ব্যান্ডউইডথের কেনাবেচা ও রাজস্ব ভাগাভাগিতে বৈষম্য বাতিল করে গ্রাহক পর্যায়ে সুলভে মানসম্মত ইন্টারনেট–সেবার পরিবেশ সৃষ্টিতে নীতিমালা সংশোধন এবং এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের চেয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসিকে পুরোপুরি স্বাধীন কমিশন হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা মনে করেন, মুষ্টিমেয় কিংবা গোষ্ঠীগত সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নীতিমালা সংশোধন না করলে বৈষম্য থেকেই নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়।  

আজ রোববার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ব্যান্ডউইডথ ও ইন্টারনেটের বৈষম্যমূলক বাজার ব্যবস্থাপনা নিরসনে করণীয় নিয়ে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিশিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে এতে ব্যান্ডউইডথ বাজারে আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈষম্যের বিষয়টি উপস্থাপন করেন সংগঠনটির গবেষণা সদস্য মো. রানা। সংগঠনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

সভায় বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউর রহমান জানান বৈষম্য নিরসনে বিটিআরসি কাজ শুরু করেছে। তিনি বলেন, আমাদের ত্রিমাত্রিকভাবে কাজ করতে হয়। সরকার, অপারেটর ও গ্রাহক—এই তিনের সমন্বয় করেই আমরা কাজ করি। সরকারি-বেসরকারি ব্যবসার এপেক্স এবং ক্যাপেক্স এক না থাকায় ব্যান্ডউইডথ মূল্যে ভিন্নতা রয়েছে। আগামী দিনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও ট্যারিফ বেঁধে দেওয়া হবে। ব্যান্ডউইডথের দাম পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। তবে এ জন্য সময় লাগবে।

রাজনৈতিক দল এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এরই মধ্যে আপনাদের দাবিগুলো আমরা উপদেষ্টাকে পাঠিয়েছি। আশা করি, বৈষম্য ঘোচাতে ডিজিটাল লুটপাট নিয়ে কী হয়েছে, তা–ও এবার আপনারা তুলে ধরবেন। চেতনা বিক্রি করে যাঁরা ইন্টারনেট তথা ডিজিটাল সেবার বিভিন্ন সূচকে আফগানিস্তানের চেয়েও রেখেছেন তাঁদের শণাক্ত করবেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আইআইজিবির সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, ‘সাধারণত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন একচেটিয়া ব্যবসা করতে না পারে, সে জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সেবায় আনা হয়। আইটিসি কম দামে ইন্টারনেট দেওয়ায় সাবমেরিন ক্যাব্‌ল কোম্পানি দাম কমাতে বাধ্য হয়। কিন্তু কোম্পানিটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় থেকেও মুনাফার দিকে বেশি মনোযোগী। ফলে তাদের ব্যান্ডউইডথ পড়ে থাকছে। বাংলাদেশে আইটিসি অপারেট না থাকলে আমি হলফ করে বলতে পারি আগামীকাল থেকে ইন্টারনেটের দাম আরও বেড়ে যাবে।’

বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্‌ল লিমিটেডর মহাব্যবস্থাপক (বিপণন ও বিক্রয়) প্রভাষ চন্দ্র ভট্টাচার্য বলেছেন, আমরাও বৈষম্যের শিকার হয়ে আমাদেরও আইটিসি থেকে ২ শতাংশ বেশি রাজস্ব শেয়ার করতে হয়। ব্যান্ডউইডথের দাম কমালেও কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

আইআইজিবি যুগ্ম সচিব মক্তবুর রহমান বলেন, ‘বিটিআরসির নীতিমালা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইন্টারনেট যে নেটওয়ার্ক ইকোসিস্টেম আছে, সেখানে মোবাইল অপারেটর ও আইএসপি উভয়েই ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এখানে দ্বৈত নীতিমালা আছে। একইভাবে দুই সরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে রেভিনিউ শেয়ার করে, সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশে ৫০০ টাকায় যে ইন্টারনেট দেওয়া হয়, এমনটা সারা বিশ্বে পাওয়া যাবে না। কনটেন্ট বা সিডিএনের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ খরচ হলেও আইএসপি তা বিক্রি করতে পারে না। এই দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। কেননা, আমাদের বোঝা দরকার ইন্টারনেট কোনো পণ্য নয়, সেবা। পণ্য কিনে আমরা মিলি সেকেন্ড হিসেবে সেবা দিই।’

নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কম দাম ও মান অনুযায়ী প্রত্যেকেরই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রেভিনিউ শেয়ার সবার জন্য সমান করলে ইন্টারনেটের দাম কমবে। সাবমেরিন কেব্‌লের ব্যান্ডউইডথ কেন পড়ে আছে। তাই এর ব্যবহার বাড়তে মূল্য কমানোর সঙ্গে মান বাড়াতে হবে। আমি তো মনে করি, তারা দেশের পাশাপাশি বিদেশে ব্যবসা করবে। আইটিসি থেকে তাদের দাম কেন বেশি হয়, তা বোধগম্য নয়। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণের কারণে ৩০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথের অপচয় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো স্তর রয়েছে। এটা কমা দরকার। রেভিনিউ শেয়ার না থাকলে এই খাতে চুরিও কমত।
 
মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়েটার রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা শাহ মো. ফজলে খোদা বলেন, ‘বোতলজাত পানির মধ্যে শুধু পানি আমাদের কাছে ব্যান্ডউইডথ। এই ব্যান্ডউইডথ ইন্টারনেট হিসেবে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে নানা খরচ রয়েছে। ওভারহেডের ২.৩ শতাংশ হচ্ছে আমাদের ব্যান্ডউইডথ কস্ট। এর ওপর রয়েছে করের বোঝা। গ্রাহকদের কাছে আমরা মাসে ১৪৫ টাকা রাজস্ব পাই। এটা প্রতিবেশী দেশের চেয়ে কম। তাই এখন ইন্টারনেটের দাম কমাতে হলে টিকে থাকাই অসম্ভব।’

আর্থ কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা সরকারি আইআইজি প্রতিষ্ঠানের কাছে ট্যারিফ নির্ধারণ করে রেভিনিউ শেয়ারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। দেশি ব্রডব্যান্ড আইএসপিকে সেবা দিতে গিয়ে নির্দিষ্ট ট্যারিফ মানতে হচ্ছে। কিন্তু এনএস অপারেটরদের জন্য কোনো ট্যারিফ নেই। বিটিআরসি থেকে এক দেশ এক রেট পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। ফলে বাজার প্রতিযোগিতায় আমরা হেরে যাচ্ছি।’
বাজারবিশ্লেষক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, রাষ্ট্র রাজস্ব আয়ে লুকানো নীতিমালা (হিডেন পলিসি) ব্যবহার করে। ফলে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। সেটি ডিমের বাজারের সঙ্গে ইন্টারনেটের বাজারেও রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র মুখে বললেও এসব জায়গায় কখনোই কিছু করে না। রাজস্ব বোর্ডই মূলত কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
     
সভায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস—বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘দেশের এক–তৃতীয়াংশ লোক নিয়মিত ডিজিটাল সেবা পেলেও এটা প্রতিবেশী দেশের তুলনায় পিছিয়ে। এখানে আমাদের সবারই ব্যর্থতা রয়েছে। কেননা, এখনো আমাদের মানুষ ইন্টারনেট বলতে ফেসবুক, টিকটক বুঝি। তাই দেশের মানুষের জন্য কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। ডেটা সহজলভ্য না হলে ইন্টারনেট বাজার বাড়বে না। ইনফো সরকার থ্রি ব্যর্থ হওয়ায় গ্রামেগঞ্জে সুলভ ইন্টারনেট তথা ব্রডব্যান্ড পৌঁছায়নি। ফলে গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের বৈষম্য তৈরি হয়েছে।’  
 

ইন্টারনেট সংযোগদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, ইন্টারনেট এখন মৌলিক অধিকার। কিন্তু সেই ইন্টারনেট নিয়ে কত প্রতারণা হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। ১/১১–এর পর আইএসপিকে দুর্বল করে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আইএসপিদের ব্যান্ডউইডথ কিনতে হয় ৩৬৫ টাকায়। অথচ আমরা সাবমেরিন কেব্‌ল ব্যান্ডউইডথ কিনে এনে ফেলে রেখেছি। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করতে এসব করা হচ্ছে। লাইসেন্স হালনাগাদের ১০০ বৈধ আইএসপি অবৈধ হয়ে গেছে।’