গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে বেসিসের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বেসিসে নানা ঘটনা দেখা যায়। বৈষম্যবিরোধী বেসিস সদস্য ব্যানারে একটি পক্ষ কমিটি বাতিলের দাবি তোলে। পরে বেসিসের সভাপতি ও একজন সহসভাপতির পদত্যাগ, নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসক নিয়োগসহ বিভিন্ন ঘটনা দেখা যায়। বেসিসে প্রশাসক নিয়োগের প্রয়োজন পড়ল কেন?
রাফেল কবির: জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অনেক কর্মী ও উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ ছিল। শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ কিন্তু একজন ফ্রিল্যান্সার। তাঁর আত্মত্যাগ জুলাই আন্দোলনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। আমাদের এসব স্বীকৃতি দিতে হবে। আগের কমিটিও মুগ্ধের বাসায় গেছে। ৫ আগস্টের আগে-পরে বেসিসে অনেক ঘটনা ঘটেছে। মে মাসে নির্বাচনের মাধ্যমে বেসিস কার্যনির্বাহী কমিটি দায়িত্ব নেয়। দুই মাস পরেই আন্দোলন। সত্যি বলতে, গত ১৭ বছরের বাস্তবতায় বেসিসের অনেক নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) ছিল না। তখন রাজনৈতিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীরা নির্বাচনে অংশ নিতেন। বেসিস বা বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠনের মূল লক্ষ্য ব্যবসা। নানা বাস্তবতায় সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি জায়গা করে নেয়। এসবের কারণে বর্তমানে অনেক পরিবর্তন দেখা গেছে। গত সরকারের দীর্ঘ সময়ে আইসিটি ছিল টাকা বানানোর বড় খাত। সাধারণ মানুষ যেহেতু আইসিটি খাত সম্পর্কে বেশি কিছু বোঝে না, তাই এ খাতে লুটপাট করার সুযোগ বেশি। আইসিটি খাতের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন—সবাই তখনকার সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর পটপরিবর্তন হলে বেসিস সদস্যদের অনেকেই নতুন বাস্তবতায় নির্বাচিত কমিটির পদত্যাগ দাবি করে। সবাই না চাইলেও কেউ কেউ এসব দাবি তোলে। ৫ আগস্টের পর তখনকার সভাপতি রাসেল টি আহমেদের সঙ্গেও আমার কথা হয়। তখন আমি একটা বিশেষ সাধারণ সভা (এজিএম) বা জরুরি সাধারণ সভা করার পরামর্শ দিই। এজিএমের মাধ্যমে সদস্যরা কী চান, তা জেনে নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিই। সেই এজিএম অবশ্য আর ডাকা হয়নি। তত দিনে আমরা বেসিসে কখনোই যা হয়নি, এমন কিছু ঘটনা দেখেছি। কার্যালয় ঘেরাও, আটক, ভাঙচুরের মতো ঘটনা দেখা গেছে। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। আবার দেখা গেছে, ৫ আগস্টের আগে অনেক বেসিস সদস্য সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমর্থন জানিয়ে অংশ নিয়েছে। এসব ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতিকে জটিল করে দেয়। ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে বেসিস বিবৃতি দিলেও সদস্যদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল।
বেসিসের বর্তমান সহায়ক কমিটিতে আপনি কীভাবে যুক্ত হলেন?
রাফেল কবির: তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আমি তিন দশক ধরে যুক্ত। যদিও আমি কখনোই বেসিসের নেতৃত্বে বা বেসিস রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলাম না। ৫ আগস্টের পর বেসিসের সভাপতি পদত্যাগ করার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রশাসক নিয়োগ করে। বেসিসের কাজ নিয়মিত পরিচালনা করার জন্য বেসিসের সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এখন ১৫ সদস্যের সেই কমিটি বেসিস সদস্যদের জন্য কাজ করছে। আমাদের এই সহায়ক কমিটির মূল কাজ হচ্ছে প্রশাসককে ১২০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করা। আমরা বেসিস সদর দপ্তরের গতিশীলতা ধরে রাখছি ও দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করছি। কাজের অংশ হিসেবে আমরা বেসিস সদস্যদের নানা ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছি। বেসিসের গঠনতন্ত্র সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, সেটা নিয়েও কাজ করছি। বেসিসের সদস্যসংখ্যা ২ হাজার ৭০০। আর ভোটারসংখ্যা ৮০০। কেন বাকিরা ভোটার নন, সেই ব্যাপারটা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি।
অতীতের বেসিস নির্বাচন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
রাফেল কবির: বেসিস নির্বাচনে আগের যে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন করা হতো, এর পরিবর্তে সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনব্যবস্থা তৈরির জন্য কাজ করছি আমরা। একটা নির্বাচনের জন্য ৫-১০ কোটি টাকা মানুষ খরচ করে। এটা বিশ্বাস করা যায় না। হোটেলে হোটেলে পার্টি দেওয়া হয় নির্বাচন উপলক্ষে। আমরা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য কাজ করছি। এটা বাণিজ্যিক সংগঠন, সেই চরিত্র বজায় রাখতে কাজ করছি। আবার দেখা যায়, একজন সদস্য একই ঠিকানা ব্যবহার করে একাধিক কোম্পানি দেখিয়ে ভোটার হন। ফলে একজনই অনেকগুলো ভোট দিতে পারেন। এটা আমরা বন্ধ করতে চাই। একজন ভোটার একটাই ভোট দেবেন—এমন সব সংস্কার আনার জন্য কাজ করছি। বেসিসের অনেক প্রকল্পে বেসিস সদস্যদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। এসব কাজ দেওয়ার জন্য অনেকেই কয়েকটা কোম্পানি খুলে কাজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন আগে। আমরা এসবও বন্ধ করতে চাই।
প্রশাসকের দায়িত্ব ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা। এটা কি সম্ভব?
রাফেল কবির: প্রশাসক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করছেন। আমরা চেষ্টা করছি ১২০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে। প্রশাসক ও সহায়ক কমিটি কাজ শুরুর পর উচ্চ আদালতে একটা রিট করা হয়েছিল। আদালত তা গ্রাহ্য না করে নিয়মিত কাজের আদেশ দেন। আমরা নির্বাচনের জন্য কাজ করছি। সবাই যেন নির্বাচনে অংশ নেন, সেই বিষয়ে কাজ করছি আমরা। আগের সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কেউ কোনো অপরাধ করলে তার অবশ্যই বিচার হবে। বেসিসের কাজ পরিচালনা করতে আগের স্ট্যান্ডিং কমিটির কিছু সদস্য পদত্যাগ করেছেন। অন্যরা আছেন, আমরা কোনো স্ট্যান্ডিং কমিটি বাতিল করিনি। তারা তাদের মতো করে কাজ করছে।
বেসিস থেকে নানা সময় সফটওয়্যার খাত থকে রপ্তানির নানা লক্ষ্যমাত্রার কথা শোনা গেছে। অনেক বছর ধরে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাত থেকে ১ বিলিয়ন, ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বেসিস। এসব কি বাস্তব?
রাফেল কবির: আগের সরকার যা বলত, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেসিসও এসব বলার চেষ্টা করত। বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। একটি বাণিজ্যিক সংগঠন হিসেবে সরকার যা বলবে, তা প্রমাণ ছাড়া বেসিসের বলার চর্চাটা ঠিক ছিল না। আমাদের দেশে আসলেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের গুরুত্ব অনেক। আমাদের জিডিপিতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবদান ১ দশমিক ২ শতাংশ। এটা আমাদের তৈরি করা কোনো পরিসংখ্যান না, আন্তর্জাতিক জরিপের ফলাফল। আইসিটির নাম দিয়ে তখনকার সরকারের অনেকেই টাকা বানিয়ে বড়লোক হয়েছে। আমাদের দেশে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফ্রিল্যান্সার আছে। আমাদের দেশে আইসিটি খাত থেকে আসলেই ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ আছে। এ বিষয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ফ্রিল্যান্সার ও আইটি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে ডলার আয়ের সুযোগ বাড়বে। আমাদের দেশে এই ইকোসিস্টেমটা নেই।
আপনাদের সহায়ক কমিটি নিয়ে রাজনৈতিক বলয়ে প্রভাব খাটানোর কথা উঠেছে।
রাফেল কবির: আমাদের কমিটিতে রাজনৈতিক মতাদর্শের সদস্য রয়েছে। আমি নিজেও একটা মতাদর্শের মানুষ। তবে রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা এই কমিটি বাস্তবায়ন করছে না বা চাপিয়ে দিচ্ছে না।
বেসিস থেকে দূরে ছিলেন কেন?
রাফেল কবির: আমি তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে ব্যবসা শুরু করি অন্যের বিনিয়োগের মাধ্যমে। সরকারি বাধার কারণে অনেক উদ্যোগ বন্ধ করে দিতে হয় আমার। এসব কারণে বেসিস বা সংগঠনভিত্তিক সংশ্লিষ্টতা থেকে আমি দূরে ছিলাম। আগের সরকার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক নীতিমালা তৈরিতে আমার সহায়তা নিয়েছিল। পরে আমার সঙ্গে আর কাজ করেনি। সমস্যা হবে বলে আমাকে সরিয়ে রাখা হয়। আমি দেশে ১৯৯৫ সালে ভিস্যাট প্রযুক্তি আনার মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার ব্যবসা শুরু করি। তখন ফজলে হাসান আবেদ আমাকে ব্যবসার জন্য টাকা দেন। এখন এমন বিনিয়োগ দেখা যায় না। আমি ১৯৯৮ সালে দেশের প্রথম টেলিহেলথ সেন্টার চালু করি। তখন প্রযুক্তির অভাবে পরে সেটাকে ডিএনএস ডায়াগনস্টিকসে পরিণত করি। আমি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম একটি ব্যাংকের সঙ্গে। কোনো অজানা কারণে সেই কাজ থেকে আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন আমার ৩০-৩৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। আমি ২০০৬ সালে বেসরকারি পর্যায়ে আর্থ স্টেশন (উপগ্রহ ভূকেন্দ্র) স্থাপন করি। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তা বন্ধ করে দেয় সরকার। সাভারে ইপিজেডের সেই আর্থ স্টেশন বন্ধ করে প্রভাবশালী এক সংসদ সদস্য সেখানে গার্মেন্টস করেন। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সেই কাজ শুরু করলেও পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশাল ঋণের চাপে পড়ি আমি। যতই সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের গল্প বলুক না কেন, তখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অনেক ব্যবসায়ীর ওপরে চাপ ছিল। নতুন সহায়ক কমিটি আমার নাম যে আসবে, তা আমার কল্পনায় ছিল না। যারা বেসিস সংস্কার চায়, তারাই আমার নাম প্রস্তাব করে। কমিটিতে নাম আসার আগে হাতে গোনা ২-৩ বার আমি বেসিস ভবনে এসেছিলাম। এখন তো প্রতিদিনই আসতে হয়। এখানে আসার জন্য আমার নিজের একটা গাড়ি ভাড়া করতে হয়েছে। আমার এত অর্থ নেই যে বেসিস নির্বাচনে কোটি টাকা নিয়ে অংশ নেব। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে সেই বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা।
বেসিস কি সংগঠন হিসেবে সফল?
রাফেল কবির: জেআরসি (অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী) কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৯৮ সালে বেসিস বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। গত ২৬ বছরে বাংলাদেশে কম্পিউটার নির্ভর সফটওয়্যার খাত ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বেসিস দারুণ কাজ করেছে। রাজনৈতিক চাপ থাকার পরও বেসিস চেষ্টা করেছে কাজ করতে। সামনের সময়ে যাতে পুরো ইকোসিস্টেম উন্নয়ন হয়, যেন তার জন্য নীতিগত উন্নয়নের কাজ করছি। এখনো সরকারি আইনের কারণে পেপ্যাল দেশে চালু করা যাচ্ছে না। আগের সরকার তো পেপ্যালের জুম-সুবিধা চালু করে কৃতিত্ব নিয়েছিল, যদিও বাস্তবে পেপ্যাল সেবা দেশে আসেনি। নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা এসব বিষয়ে সমাধান করতে পারি। সরকারকে এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে। আগের সরকারের সময় আইসিটি খাতের অনেক বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। পছন্দের মানুষকেই অর্থায়ন করা হতো স্টার্টআপের নামে। আইসিটি বিভাগের স্টার্টআপ বাংলাদেশসহ অনেক কাজে রাজনৈতিক মতাদর্শও প্রভাব চোখে পড়ত। এসব আসলে সামগ্রিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য ভালো হয়নি। বেসিস এখন সেমিকন্ডাক্টর শিল্পসহ প্রযুক্তির আধুনিক সব খাত নিয়ে কাজ করছে। আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস), ব্লকচেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে শুরু করে সব খাতেই আমাদের কাজের সুযোগ আছে। আমাদের দেশে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া কাজ করতে চাই। আমরা সেমিকন্ডাক্টরশিল্পের জন্য একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি তৈরি করেছি। আমাদের দেশে সেমিকন্ডাক্টরশিল্পের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন ও খাতসংশ্লিষ্ট সুযোগ বিকাশের জন্য কাজ করছি আমরা।
আপনাকে ধন্যবাদ।
রাফেল কবির: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।