জয়ের স্বপ্নে উচ্ছ্বসিত তরুণেরা
অবারিত প্রযুক্তির যুগে তুমুল প্রতিযোগিতায় বেড়ে উঠছেন এখনকার তরুণেরা। স্বপ্নপূরণের লড়াইয়ে শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, বাড়াতে হবে ‘সফট স্কিল’-এর পরিধি। এ পরিধি বাড়াতে অর্জন করতে হবে যোগাযোগ ও প্রযুক্তি দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সংবেদনশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আত্মবিশ্বাস, নিজেকে উপস্থাপনের সক্ষমতা এবং ইতিবাচক মানসিকতা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিতে এর কোনো বিকল্প নেই। দেশের বিভিন্ন খাতের সফল নেতাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এমন সব নির্দেশনা।
প্রায় পাঁচ হাজার উদ্দীপ্ত তরুণের সরব উপস্থিতিতে গতকাল বুধবার রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হলো তারুণ্যের জয়োৎসব। ক্রাউন সিমেন্ট ও প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত এ উৎসবে আগামী জয়ের স্বপ্নে দিনভর উচ্ছ্বসিত ছিলেন তরুণ-তরুণীরা। একাধিক অধিবেশনে সরকারি চাকরি, ক্যারিয়ার-সংক্রান্ত প্রস্তুতি, প্রযুক্তি খাত, ফ্রিল্যান্সিং, উপস্থাপনা ও পেশাগত উন্নয়ন কিংবা শখকে পেশায় পরিণত করার নানা পরামর্শ জানার সুযোগ পেয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা। সফলদের কাছ থেকে সরাসরি জেনেছেন নিজেদের নানা জিজ্ঞাসা, জেনেছেন জয়ের গল্প।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে তরুণেরা কী করবেন, চাকরির পেছনে ছুটবেন নাকি নিজের দিকে পথ ঘুরিয়ে উদ্যোক্তা হবেন। উদ্যোক্তা হতে পদে পদে নানা চ্যালেঞ্জ আর ঝুঁকি। আবার শ্রমবাজার প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। যুক্ত হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। সে ক্ষেত্রে তরুণদের কী করণীয়? প্রতিযোগিতার বাজারে তো পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। এখন তাঁদের ঘুরে দাঁড়াতে বললেন সফলেরা। তারুণ্যের জয়োৎসবের এবারের স্লোগান ‘পথ ঘোরাও নিজের পথে’ বারবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁদের কণ্ঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন, শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে ধারণা দিতে এবং চাকরির বাজারে থাকা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে এই আয়োজন। সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এ উৎসব শুরু হয়। ‘একুশ শতকের স্বপ্নযাত্রা’ শীর্ষক প্রথম অধিবেশনে বিজিএমইএর সভাপতি ও মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, ‘যা কিছু আমাদের বড় করে, তা হলো আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ইচ্ছা। তাই নিজের ইচ্ছা ও স্বপ্নকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে।’
ক্রাউন সিমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তরুণেরাই দেশের সম্পদ। আজ যাঁরা সফল, তাঁরা তরুণ বয়স থেকেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। নিজেদের তৈরি করতে তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বিনয়ী ও সৎ হও। সফল হতে সংকল্প থাকতে হবে। কাজের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রাখতে হবে। তবে সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে।’
আলোচক পাঠাও-এর প্রধান নির্বাহী হুসেইন এম ইলিয়াস বলেন, ‘উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন কিছু শুরু করতে পুঁজি লাগে না, খুব বেশি বুদ্ধিও লাগে না। শুধু ইচ্ছা লাগে। তোমাকে যেটা বেশি সুখী করবে, সেটা করারই চেষ্টা করো।’
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘প্রথম আলোর একটাই লক্ষ্য, আমরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই, তরুণদের জয় দেখতে চাই। তরুণেরাই সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান বলেন, ‘তোমরা হতাশ হবে না। তুমি যদি তৈরি হও, তবে তোমার নেতৃত্ব, ভালোবাসার জন্য সারা দুনিয়া অপেক্ষা করছে।’
২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে শুরু হয়েছিল তারুণ্যের জয়োৎসব। পরে দেশের ৩২টি অঞ্চলে এ উৎসব ও কর্মশালা হয়। অংশ নেন ১০ হাজার তরুণ। গতকালের জাতীয় পর্বে সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, বরগুনা, সিলেট, রংপুর, ফরিদপুর, ভোলা, কুড়িগ্রাম, যশোরসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা অংশ নেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী আসমা সুলতানা বলেন, ‘এখানে এসে অসংখ্য নতুন বন্ধু পেলাম। বন্ধুদের ভাবনাগুলো জানতে পারলাম। বাসা থেকে সব সময় বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার কথা বলে। বিসিএস উত্তরণের রাস্তা খুঁজতে নানা পরামর্শ পেলাম।’ চাঁদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি উদ্ভাবনী কিছু করতে চাই। কিন্তু কোত্থেকে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। জানতে এসেছি, উদ্যোক্তা হতে হলে কী কী করতে হবে।’
সারা দিনে মোট ১১টি অধিবেশন ও ৫টি কর্মশালা হয়। আলোচক হিসেবে ছিলেন জনপ্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক খাত, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্রসহ বিভিন্ন খাতের ৫৩ জন ব্যক্তিত্ব। উদ্বোধনের পর উৎসবস্থলের মিলনায়তন, সেমিনার ও থ্রিডি হলে সময়ের সঙ্গে সমান্তরালে চলতে থাকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দক্ষতা, নেতাদের সঙ্গে তরুণ নেতা, বিশ্বের হাতছানি, টেক জায়েন্ট ক্যারিয়ার, উপস্থাপন করো নিজেকে, নতুন বাস্তবতায় ফ্রিল্যান্সিং, প্রতিষ্ঠাতার যাত্রা, ‘হতে হবে বৈশ্বিক গ্রামের বাসিন্দা’ বিষয়ক অধিবেশন। ছিল পেশাগত উন্নয়ন, সিভি ডক্টর, মেডিকেল স্ক্রাইবিং, ক্যারিয়ার পরামর্শ, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি শীর্ষক কর্মশালা। উৎসবস্থলে ছিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, একসেস টু ইনফরমেশন ইনিশিয়েটিভ, ব্র্যাক, ইউথ অপরচুনিটিস, ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠানের স্টল। সেখান থেকেও তরুণেরা ক্যারিয়ার, উচ্চশিক্ষা ও উদ্যোক্তাবিষয়ক নানা পরামর্শ পান।
সন্ধ্যায় তরুণ-তরুণীর ব্যাপক হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে মঞ্চে আসে জলের গান। আটটি গান গেয়ে শোনায় হালের জনপ্রিয় এ গানের দল। ‘এমন যদি হতো, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ…’ জলের গানের এই গানের মতোই উড়তে চান এখনকার তরুণেরা। চোখে স্বপ্ন, প্রাণে উচ্ছ্বাস আর সফলদের দেওয়া প্রেরণা নিয়েই তারুণ্যের জয়োৎসব থেকে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।