২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

শেষ দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা

আজ আর্জেন্টিনা-জার্মানি ফাইনাল
আজ আর্জেন্টিনা-জার্মানি ফাইনাল

ডিয়েগো ম্যারাডোনা কি আজ মারাকানায় থাকবেন?
দুই রকমই শোনা গেল।
দুই যুগ পর বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা কি না এসে পারেন?
ম্যারাডোনা আসবেন না। কারণ আর্জেন্টিনার জন্য তিনি ‘কুফা’।
ম্যারাডোনা আসবেন কি আসবেন না এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ফাইনালে মিক জ্যাগার কোন দলকে সমর্থন করছেন? এটি জানলে বিশ্বকাপ কে জিতবে তা আগেভাগেই জেনে ফেলা যায়। রোলিং স্টোনস গায়ক কোনো দলকে সমর্থন করলে সেটির যে না হেরে উপায় নেই। তাঁর এই ‘ক্ষমতা’ গত বিশ্বকাপ থেকেই আলোচিত। এই বিশ্বকাপেও যেটির প্রকাশ ঘটেছে। চারটি দলের প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। চারটিই বিদায় নিয়েছে। ব্রাজিলের বিপক্ষে ৭-১ গোলে জয়ের কৃতিত্বও জার্মানদের চেয়ে জ্যাগারই বেশি পাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্রাজিলিয়ানদের কাছ থেকে অকথ্য গালাগালিও।
কাল সকালে দৃশ্যটা দেখে তাই একটুও অবাক হলাম না, মারাকানার বাইরে এক দল জার্মান আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মিক জ্যাগারের কাটআউট ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আগের দিন রাতেই যে কোপাকাবানায় আর্জেন্টাইনরা জ্যাগারকে জার্মান জার্সি পরিয়ে দিয়েছে, এটা অবশ্য তাদের জানাই নেই। জ্যাগারের সমর্থন এমনই ভয়াবহ যে, এসবে খুব একটা কাজ হয় বলে মনে হয় না। বেলো হরিজন্তেতে জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচের দিন ব্রাজিলিয়ানদের টোটকাটা তাহলে বিফলে যেত না। জ্যাগার মাঠে থাকবেন জেনে গ্যালারিতে জার্মানির জার্সি পরা জ্যাগারের অনেকগুলো কাটআউটই তো ছিল।
এসব কুসংস্কারের কথা থাক। মিক জ্যাগার কি বিশ্বকাপ ফাইনালের মীমাংসা করবেন নাকি! তা হলে কে করবেন? লিওনেল মেসি? জার্মান শিবির থেকে হুংকার শোনা যাচ্ছে, ডাচরা মেসিকে কেমন হাঁসফাঁস করিয়েছে, সেটি তাঁরা দেখেছেন। মেসি নামের ‘দৈত্য’কে বোতলবন্দী করে রাখতে তাদেরও বিশেষ পরিকল্পনা আছে।
ফাইনালটা কি তাহলে লিওনেল মেসি বনাম জার্মানি? আর্জেন্টিনার সর্বশেষ দুটি ম্যাচ তা বলতে দিচ্ছে না। বেলজিয়াম ও হল্যান্ডের বাধা টপকানোয় মেসির চেয়েও যাঁর বড় ভূমিকা দেখছেন অনেকে, তাঁর কাছ থেকেই অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটা পেয়েছেন মেসি। যাঁকে আলেসান্দ্রো সাবেলা বলছেন, মাঠে ও মাঠের বাইরে এই আর্জেন্টিনা দলের প্রতীক। হাভিয়ের মাচেরানোর এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠাটা এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার খেলার ধরনটাও বুঝিয়ে দিচ্ছে। আগে ঘর সামলানো এবং প্রতিপক্ষকে খেলার জায়গা না দিতে জীবন বাজি রাখা—এই দুই দর্শনের ফল, সর্বশেষ ৩৭৩ মিনিট আর্জেন্টিনার জালে কোনো বল ঢোকেনি।
এই বিশ্বকাপ অনেক কিছুতেই চমকে দিয়েছে। যেমন চমক লাগছে ফাইনালের আগে প্রিভিউ লিখতে বসে। আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি মানে তো লাতিন আমেরিকা বনাম ইউরোপ। কিন্তু এত বছর ধরে লালিত ফুটবলের এই দুই ঘরানার মূল সুরটাই তো বদলে গেছে এবার। লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা খেলছে ইউরোপিয়ান দলগুলোর মতো হিসাবি ফুটবল আর ইউরোপের জার্মানি যেন পরিণত লাতিন আমেরিকান কোনো দলে। এত দিন ‘লড়াই-টড়াই’জাতীয় শব্দগুলো জার্মানি-ইংল্যান্ড-ইতালির মতো দলগুলোর সঙ্গেই বেশি যেত। এবার লড়াই কাকে বলে, সেটি বুঝিয়ে দিচ্ছে আর্জেন্টিনা। লাতিন আমেরিকান ফুটবলের সঙ্গে যে ‘ফ্লেয়ার’ শব্দটার যুগলবন্দী, সেটিও জার্মানির মতো আর কোনো দলের সঙ্গে যাচ্ছে না। ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচের জার্মানিকে দেখে রোনালদিনহো তো বলেই দিয়েছেন, জার্মানিই এই সময়ের ‘ব্রাজিল।’ তার পরও খেলায় যতই লাতিন ছোঁয়া লাগুক, জার্মানি জিতলে নতুন একটা ইতিহাসও লেখা হবে। দক্ষিণ আমেরিকায় প্রথম বিশ্বকাপ জিতবে ইউরোপের কোনো দল।
আর্জেন্টিনা তো ফাইনালেই উঠল ২৪ বছর পর। সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছে ২৮ বছর আগে। জার্মানির অপেক্ষাও কিন্তু কম দিনের নয়। ১৯৯০ সালে ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয়। বিশ্বকাপ ফাইনালে গোলের খরা শুরুও সেবার থেকেই। ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সর্বশেষ ৬টি বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল হয়েছে মাত্র ৯টি। যেখানে ১৯৬৬ থেকে শুরু করে এর আগের ৬টি ফাইনাল দেখেছিল ২৭ গোল।
এই বিশ্বকাপ যত এগিয়েছে, ততই গোলের আকাল দেখা দিয়েছে। ফাইনালেও এই ধারা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সাফল্যপিয়াসী এই সময়ে এত বড় একটা অর্জনের সামনে দাঁড়িয়ে কোন দলই বা বড় কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবে? টমাস মুলারের কথা শুনে তো মনে হলো, তিনি সেট পিসেই মীমাংসা দেখছেন ফাইনালের। সেটি বলার সময় অবশ্য আর্জেন্টিনার প্রতি প্রচ্ছন্ন একটা হুমকিও থাকছে, ‘খেলাটা বেশি আঁটসাঁট হলে সেট পিস থেকে গোল করতে হবে। সমস্যা কী, আমরাই তো এখন সেট পিসের রাজা।’
প্রথম ম্যাচে পর্তুগালকে উড়িয়ে দিয়ে শুরু। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে অমন অবিশ্বাস্য গোলবন্যা বইয়ে দিয়ে জয়। জার্মান আত্মবিশ্বাস যে আকাশ ছুঁয়েছে, তাতে আর আশ্চর্য কী! যে কারণে মুলার বলতে পারছেন, ‘আমি জানি না খেলাটা কী ধরনের হবে। তবে আমাদের কী করতে হবে সেটি আমরা জানি।’
বড় টুর্নামেন্ট শেষে বার্লিনে সমর্থকদের সঙ্গে উৎসব করাটা জার্মান ফুটবলে একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটি শিরোপা না জিতলেও। তবে এবার বিশ্বকাপটা জিতেই উৎসব করতে চায় জার্মানি। সাবেক স্ট্রাইকার অলিভার বিয়েরহফ এখন জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের মহাব্যবস্থাপক। এখানে দলের সঙ্গেই আছেন। তিনি বলে দিয়েছেন, এবার উৎসব হবে শুধু চ্যাম্পিয়ন হলেই, ‘২০০৬ বিশ্বকাপে তৃতীয় হয়ে আমরা সমর্থকদের সঙ্গে উদ্যাপন করেছি, ২০০৮ ইউরোতে দ্বিতীয় হয়েও। তবে এবার শুধু জিতলেই তা করব এবং সেটি করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’
দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কথা বললে অবশ্য এবার আর্জেন্টিনার নামটাই আগে আসে। সেমিফাইনালে ঠোঁটে সেলাই নিয়েও দুর্দান্ত খেলে যেটির প্রতীক হয়ে গেছেন জাবালেতা। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার ফাইনালে জার্মানিকে ফেবারিট মানছেন, তবে এরপরই মনে করিয়ে দিচ্ছেন আর্জেন্টিনায় প্রচলিত একটা প্রবাদ, ‘আমরা ফাইনাল খেলি না। আমরা ফাইনাল জিতি।’ যদিও কথাটা সেমিফাইনাল প্রসঙ্গেই বেশি খাটত। আর্জেন্টিনা কখনো বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারেনি। বিশ্বকাপ ফাইনাল দুটি যেমন জিতেছে, দুটি তো হেরেছেও।
বিতর্কিত পেনাল্টিতে ১৯৯০ ফাইনালে হারার পর ম্যারাডোনার কান্না হয়ে আছে বিশ্বকাপের অমর ছবিগুলোর একটি। জার্মানির এই দলে একজনের বিশ্বকাপ ফাইনালে হারার কষ্টটা জানা আছে। সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়া বিশ্বকাপে সেই কষ্ট আর পেতে রাজি নন মিরোস্লাভ ক্লোসা। ২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে পরাজয়ের কথা স্মরণ করে বলেছেন, ‘বিশ্বকাপ ফাইনালে হারার যন্ত্রণাটা আমি খুব ভালোমতোই জানি। আবার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।’
আজ যে মারাকানা মহারণের যুদ্ধক্ষেত্র, সেটির মূল প্রবেশদ্বারে হিল্ডেরাল্ডো বেলিনির একটি মূর্তি আছে। গত মার্চে প্রয়াত ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক জুলে রিমে ট্রফিটা মাথার ওপর তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। এই মাথার ওপর ট্রফি তুলে ধরার রীতিটাও নাকি বেলিনিই শুরু করেছিলেন। স্টকহোমে ফাইনাল শেষে ব্রাজিলিয়ান ফটোগ্রাফাররা লম্বা-চওড়া সুইডিশ ফটোগ্রাফারদের পেছনে পড়ে গিয়ে চিৎকার করছিলেন বেলিনিকে ট্রফিটা তুলে ধরতে। যাতে তাঁরা ছবিটা পান।
আজ মারাকানায় আতশবাজি আর উড়ন্ত কনফেত্তির নিচে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর বিশ্বকাপ তুলে ধরবেন কে—ফিলিপ লাম, না লিওনেল মেসি? এক মাসের মহাযজ্ঞ এখন এসে কেন্দ্রীভূত কোটি টাকার এই প্রশ্নে।