অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়!! অচিন্তনীয়!!! অকল্পনীয়!!!!
এই জাতীয় আর কী কী শব্দ আছে বলুন তো! এত কিছু বলেও যে এস্তাদিও মিনেরাওয়ের এই ভুতুড়ে সন্ধ্যাকে বোঝানো যাচ্ছে না।
৬০ হাজারের মতো দর্শক দেখলেন এবং অবিশ্বাসে চোখে কচলালেন। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না—কথাটার আসল মর্মবাণীও যেন প্রথম বুঝলেন। সেটি বুঝতে স্টেডিয়ামে থাকারই বা কি প্রয়োজন! বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি টেলিভিশন দর্শকেরও কি এই ম্যাচ দেখে একই অনুভূতি হয়নি? যা দেখছি, এ কি সত্যি! নাকি মায়াবী কোনো বিভ্রম!
ম্যাচের ২৯ মিনিট পর স্টেডিয়ামের বড় পর্দায় ভেসে উঠল অবিশ্বাস্য এক স্কোরলাইন—জার্মানি ৫: ব্রাজিল ০! ধেৎ, এ হতে পারে নাকি! বিশ্বকাপ ইতিহাসেই তো কোনো দল সেমিফাইনালের প্রথমার্ধে পাঁচ গোল খায়নি। আর এখানে ব্রাজিল, নিজের মাঠে ব্রাজিল, হেক্সা জয়ের স্বপ্নে বিভোর ব্রাজিল ২৯ মিনিটের মধ্যেই কীভাবে পাঁচ গোল খেয়ে ফেলে!
বিশ্বকাপে এর আগে একবারই এক ম্যাচে পাঁচ গোল খেয়েছিল ব্রাজিল। সেটি ১৯৩৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপে। পোল্যান্ডের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো সেই ম্যাচে পাঁচ গোল খেয়ে ছয়টি দিয়েছিল ব্রাজিল। হ্যাটট্রিক করেছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রথম সুপারস্টার লিওডিনাস ডা সিলভা।
সেটি অবশ্যই ৫-০ হয়ে যাওয়ার পর নয়। নির্ধারিত সময়ে ৪-৪ ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে লিওডিনাস দুই গোল করার পর পোল্যান্ডের পঞ্চম গোল। পাঁচ গোল খাওয়া নিয়ে এত গবেষণার অবশ্য কোনো অর্থই থাকছে না, কারণ শেষ পর্যন্ত ‘ব্রাজিলিয়ান লজ্জা’ তো পাঁচ গোলেও শেষ হয়নি। দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুই গোল করে স্কোরলাইনটাকে ৭-০ বানিয়ে ফেললেন আন্দ্রে শুরলে। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে কোনো দল সাত গোল করল এই প্রথম।
অল্প শোকে মানুষ কাতর হয়। আরেকটু বেশি শোকে কাঁদে। অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। কিন্তু অভাবনীয় কিছু হলে একটা সময় বিচিত্র আচরণ করতে থাকে। কাল এস্তাদিও মিনেইরোর গ্যালারি ভালোমতোই এর প্রমাণ দিল। যখন শেষ বাঁশি বাজার অপেক্ষা, অস্কার একটি গোল শোধ করায় গ্যালারি থেকে গোওওল-গোওওল বলে যে চিৎকারটা উঠল, তাতে মনে হতেই পারত এতে স্কোরলাইন ৭-১ হয়নি। ব্রাজিল বোধ হয় সমতা এনে ফেলেছে।
বিকেলে স্টেডিয়ামমুখী ব্রাজিলের বাসকে অনেকটা সময় অনুসরণ করল টেলিভিশন ক্যামেরা। কাচের আড়াল ভেদ করে দেখা যাচ্ছিল, ব্রাজিলিয়ানরা গান গাইছে। বাস থেকে একে একে নেমে এলেন সবাই। সবার মাথায় সাদা টুপিতে লেখা—Forca Neymar। নেইমার তুমি শক্ত থাকো। এই ম্যাচ শুরুর ১০ মিনিট পর থেকেই যেসব ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটতে শুরু করল, তাতে নেইমার শক্ত থাকবেন কি, বরং তাঁর পিঠের ব্যথা নির্ঘাত বুকে চলে আসার কথা।
নেইমার থাকলেও এমন কিছু হতো কি না, এই প্রশ্নই অবান্তর। কিন্তু ম্যাচ শুরুর আগে প্রতিটি খেলোয়াড়কে জড়িয়ে ধরে যিনি উৎসাহ দিলেন, সেই থিয়াগো সিলভার অভাবটা প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করল ব্রাজিল। সেই অভাব শুধু একজন ডিফেন্ডারের নয়, ডিফেন্সে একজন নেতার। ডিফেন্স বলতে কাল কিছু তো ছিলই না ব্রাজিলের। ক্রুসের কর্নার থেকে টমাস মুলার ভলিতে প্রথম গোল করলেন। আশপাশে কোনো ডিফেন্ডার নেই, স্কুল ফুটবলেও এমন ফাঁকায় বল পাওয়াটা যেকোনো খেলোয়াড়ের স্বপ্ন।
২২ থেকে ২৯—এই আট মিনিটে যা হলো, বিশ্বকাপ কোনো দিন এমন কিছু দেখেনি। জার্মানি যেন ইচ্ছা হলো আর গোলের পর গোল করে গেল। টনি ক্রুস দুটি গোল করলেন, খেদিরা একটি, অন্য গোলটির আবার বিশেষ মহিমা। ২২ মিনিটে জার্মানির দ্বিতীয় গোলটি করেই যে মিরোস্লাভ ক্লোসা বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্কোরার হয়ে গেলেন।
বেলো হরিজেন্তের এই রাত যেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলকে কালিমালিপ্ত করার সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছিল। গৌরবের যা কিছু আছে, সব কেড়ে নেওয়ারও। সেই ১৯২০ সালে উরুগুয়ের বিপক্ষে ৬-০ গোলে হেরেছিল ব্রাজিল, ৭-১ যোগ-বিয়োগে ছয় গোলের ব্যবধানই বলে। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরাজয় হিসেবে লেখা থাকবে এটিই।
গৌরব কেড়ে নেওয়ার কথা বলছিলাম। এই ম্যাচের আগে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড ছিল ব্রাজিলের। সেটি কেড়ে নিল জার্মানি। ক্লোসাও কেড়ে নিলেন রোনালদোর রেকর্ড। যিনি বিরস মুখে কোন একটা টেলিভিশনে ধারাভাষ্য দিতে মিডিয়া ট্রিবিউনে কয়েক সারি আগেই বসা।
ম্যাচের শুরুতে গ্যালারিতে হলুদ গর্জনে যে জার্মানদের উপস্থিতিই টের পাওয়া যাচ্ছিল না, আধঘণ্টা পর থেকে মনে হলো তাঁরাই বুঝি সংখ্যাগরিষ্ঠ। ম্যাচ শেষে জার্মান খেলোয়াড়েরা তাঁদের সামনে, অভিবাদন দেওয়া-নেওয়া হলো। আর ব্রাজিলিয়ানরা তখন কাঁদছে। এই ম্যাচের অধিনায়ক ডেভিড লুইজকে জড়িয়ে ধরে মাঠ থেকে বের করে আনলেন থিয়াগো সিলভা। মার্সেলো কাঁদছেন, অস্কার কাঁদছেন, কে না...!
এক-দুই গোলে সেমিফাইনাল হারলেও কান্নাকাটি হতো আর এ তো শুধুই একটা পরাজয় নয়। ব্রাজিলের ফুটবল অভিধানে ‘মারাকানাজো’র পাশে ‘মিনেইরোজো’ও যে লেখা হয়ে গেল এখানে!
ব্রাজিল জার্মানি সেমিফাইনালের সব গোল একসঙ্গে