পুরো বিশ্বকাপেই প্রথম আলোর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের সেরা ফুটবল-বিশ্লেষক গোলাম সারোয়ার টিপু। ফাইনালের আগে নির্বাচন করেছেন এই বিশ্বকাপের সেরা একাদশ। সঙ্গে পছন্দের অধিনায়ক-কোচও।
গোলরক্ষক
ম্যানুয়েল নয়্যার (জার্মানি)
পোস্টের নিচে নিবেদিতপ্রাণ। এবার তো সুইপারের মতোই খেলেছেন। আশ্চর্য ধারাবাহিক। একই সঙ্গে খুব আগ্রাসী। কোনোরকম গোল হজম করতে রাজি নন। ব্রাজিলের জালে জার্মানি ৭ গোল দেওয়ার পরও নয়্যার একটা গোল হজম করে সেটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বুদ্ধিমত্তা ও অনুমানক্ষমতা দারুণ। এসবই তাঁকে এগিয়ে রাখছে অন্যদের চেয়ে।
রক্ষণ
ফিলিপ লাম (জার্মানি)
রক্ষণে যেকোনো পজিশনেই খেলার ক্ষমতা আছে। রক্ষণই মূল কাজ হলেও ওপরে ওঠায় জুড়ি নেই। সাবলীলভাবে পাস দিয়ে যান এবং পাসগুলো নিখুঁত। গোল আটকানোর দায়িত্ব মাথায় নিয়েও গোলে শট নিয়ে থাকেন প্রায়ই। সব মিলিয়ে রাইটব্যাক লামকে ছাড়া বিশ্বকাপের সেরা একাদশ অসম্পূর্ণই।
ম্যাটস হামেলস (জার্মানি)
উচ্চতা ভালো। নিজের বক্সে কর্নারে তো বটেই, প্রতিপক্ষের বক্সে তাঁর দলের কর্নারেও ভালো হেড করেন। মিডফিল্ডারদের সঙ্গে বোঝাপড়া ভালো। দলের জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন স্টপারের যা যা গুণ থাকা প্রয়োজন, সবই আছে হামেলসের। তাঁকে খুবই মনে ধরেছে আমার। সেরা একাদশে না রেখে তাই পারছি না।
এজেকিয়েল গারাই (আর্জেন্টিনা)
ব্লকিংক্ষমতা দারুণ। তাঁকে হারানো কঠিন। জায়গামতো থাকেন বলে রক্ষণের ভারসাম্য থাকে সব সময়ই। তাঁর সঙ্গে বাতাসের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়েরা পেরে ওঠেন না। ফলে রক্ষণে বড় এক নির্ভরতা হয়ে উঠেছেন ২৭ বছর বয়সী স্টপার।
মার্কোস রোহো (আর্জেন্টিনা)
উজ্জীবিত হয়ে খেলেন এই লেফটব্যাক। ভুল করেন কম। ওভারলল্যাপ করে ওপরে ওঠেন দলের প্রয়োজনে। ভালো ট্যাকলার, সার্ভিসগুলোও সুন্দর। এই তরুণ পেছন ফেলছেন অনেক বড় বড় তারকাকে। এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার রক্ষণে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
মধ্যমাঠ
হাভিয়ের মাচেরানো (আর্জেন্টিনা)
রক্ষণ আর মাঝমাঠের মধ্যে যেন এক সাঁকো। রক্ষণকাজে ভালো সহায়তা করছেন। শুধু তা-ই নয়, ম্যাচের ফল নির্ধারণে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেমিফাইনালে হল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে তাঁর ট্যাকলেই ম্যাচ বাঁচাল আর্জেন্টিনা। রোবেনের শটটা হয় গোলে যেত, নইলে পেনাল্টি। মাচেরানো কোনোটিই হতে দেননি। ওই একটা সেভ মাচেরানোকে উজ্জ্বল করে তুলেছে কয়েক গুণ।
বাস্তিয়ান শোয়েনস্টাইগার (জার্মানি)
সত্যিকারের জার্মান মেশিন। যে মেশিন দৌড়াতে পারে অবিরাম। প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করতে যাঁর কোনো তুলনা হয় না। তাঁর মতো খেলোয়াড় রক্ষণের সামনে থাকলে কোচের চিন্তা কমে যায় অনেকটাই। আপাদমস্তক নির্ভরযোগ্য এক খেলোয়াড়।
আক্রমণ
হামেস রদ্রিগেজ (কলম্বিয়া)
এই বিশ্বকাপের নজরকাড়া তরুণ তুর্কি। যাঁর নামের পাশে এখন পর্যন্ত ৬ গোল। মুলার বা মেসি তাঁকে টপকে যেতে পেরেছেন কি না সেটা গত রাতে আপনার জানা হয়ে গেছে। তবে কলম্বিয়ান তরুণ মনে দাগ রেখে গেছেন। বড় বড় তারকার সঙ্গে টক্কর দিয়ে নিজেকে চেনালেন আলাদা করে।
লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা)
ফাইনালের আগ পর্যন্ত জাদুকর সেরা ফর্মে দেখা দেননি। তবে ঝলক দেখিয়েছেন সময় সময়। তাতেই দল ফাইনালে। মাঠে পরিশ্রম হয়তো কম করেন, আসলে মেসির মতো খেলোয়াড়ের বলের পেছনে সারাক্ষণ দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই। এক-দুটি টাচেই খুন করতে পারেন প্রতিপক্ষকে।
নেইমার (ব্রাজিল)
দলের জন্য একটা বড় শক্তি। খেলাটা তৈরি করার ক্ষমতা আছে। একক নৈপুণ্যেও দারুণ। ব্রাজিল ফুটবলের পোস্টারবয় হয়ে উঠেছিলেন এই বিশ্বকাপে। চোটের কারণে সেমিফাইনালে আগে গেলেন ছিটকে। গোলে শট নিতে পারেন, সতীর্থদের বলে সাজিয়ে দেন প্লেটে সাজানো খাবারের মতো।
টমাস মুলার (জার্মানি)
সবার ওপরে থাকেবেন গোল করার জন্য। মেসি-নেইমার বানিয়ে দিলে গোল করতে একজন লোকের প্রয়োজন হবে। মুলারের চেয়ে উপযুক্ত লোক আর হতে পারে না। ফাইনালের আগ পর্যন্ত গোল করেছেন পাঁচটি। গত বিশ্বকাপেও ৫ গোল করে গোল্ডেন বল নিজের করে নেন জার্মানির এই স্ট্রাইকার।
অধিনায়ক
মেসি। ফুটবলে অধিনায়কের খুব একটা কাজ নেই। এটা একধরনের সম্মান। সেই সম্মানটা আমার দলে লামের চেয়ে বেশি প্রাপ্য মেসির। দলের সেরা খেলোয়াড়ের হাতেই সবচেয়ে ভালো শোভা পায় অধিনায়কের বাহুবন্ধনী। মেসি আগের চেয়ে অনেক পরিণত। এই বিশ্বকাপে দেখছি নেতা হিসেবেও ভালো করছেন।
ছক ৪-২-৩–১
যে খেলোয়াড়দের আমি দলে নিয়েছি, ছকটা ৪-২-৩-১-এ সাজালেই সবচেয়ে ভালো হবে মনে হচ্ছে। আধুনিক ফুটবল এই ছকেই বেশি যাচ্ছে এখন। তার পরও ছক ব্যাপারটা নির্দিষ্ট কিছু নয়। এটা পরিবর্তন হতে পারে। আমি মনে করি, ছকটা ম্যাচের আগে খেলোয়াড়দের কার কী দায়িত্ব সেটা বোঝানোর জন্যই বেশি প্রয়োজন। ম্যাচের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করেই কোচ আসলে রণকৌশল ঠিক করবেন।
কোচ
লুই ফন গাল। হল্যান্ড দলটাকে যেভাবে খেলান, আমার খুবই ভালো লাগে। যখন যেভাবে প্রয়োজন পরিকল্পনা পাল্টান। একটা ছক নিয়ে বসে থাকার লোক নন ফন গাল। তাঁর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ একটাই, আর্জেন্টিনার সঙ্গে সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে প্রথম শটটা কেন ডিফেন্ডার রন ভ্লারকে নিতে দিলেন? ওই সময় আর্জেন্টিনার প্রথম শটটা নেন মেসি, তাঁর দেখানো পথে আর্জেন্টিনা পরের শটগুলোও ভালো নিয়েছে। হল্যান্ড সেটা পারেনি। তার পরও ফন গালই আমার চোখে এই বিশ্বকাপের সেরা ট্যাকটিশিয়ান।
এরই মধ্যে কোচ হিসেবে সবার আলাদা নজর কেড়েছেন লুই ফন গাল। ফুটবল-মস্তিষ্ক খুবই ক্ষুরধার। ম্যাচের মধ্যেই ক্ষণে ক্ষণে রণকৌশল পাল্টে প্রতিপক্ষকে ফেলে দিতে পারেন গোলকধাঁধায়। তারই ফসল ঘরে তুলে ব্রাজিল বিশ্বকাপে হল্যান্ডকে তুলে আনেন সেমিফাইনালে। ফাইনালে উঠতে না পারলেও এই বিশ্বকাপের সেরা কোচ ফন গালই।