বাংলাদেশকে আশা দেখাচ্ছে ৫ কারণ
গত জানুয়ারিতে জাতীয় ফুটবল দলে হাভিয়ের কাবরেরা যুগ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি শোনা গিয়েছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ শব্দটি। এবার এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব শুরু হওয়ার আগে থেকে শোনা যাচ্ছে ‘লো ব্লক’ (নিচে নেমে রক্ষণভাগ সামলানো) কথাটি।
দুটি শব্দের মধ্যেই অলক্ষ্যে খেলা করে হার এড়ানোর বিষয়টি। তাঁর মুখ থেকে ‘জিততে চাই’ বাক্যটি শুনলে প্রথমে তাই একটু ধাক্কা লাগে।
অথচ আজ তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে কাল কুয়ালালামপুরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে সেই জয়ের আশাই দেখিয়েছেন জামাল ভূঁইয়াদের কোচ। র্যাঙ্কিংয়ে ৫৪ ধাপ এগিয়ে থাকা দলের সঙ্গে ড্র হলেও বাংলাদেশের কাছে সেটা হবে জয়েরই সমান।
কুয়ালালামপুরের বুকিত জলিল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় বেলা সোয়া তিনটায় শুরু হওয়া ম্যাচে এগিয়ে থাকা দলের বিপক্ষে জয়ের সাহস কোথায় পাচ্ছে বাংলাদেশ দল? তা কোচ ও খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে খোঁজার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো।
১. দল হয়ে রক্ষণ সামলানো
‘ফুটবল-বিশ্বে কিছু বিরক্তিকর দল থাকে, যারা খুব কঠিনভাবে রক্ষণভাগ সামলে ও ভালো খেলে প্রতিপক্ষকে বিরক্ত করে। প্রতিপক্ষকে বিরক্ত করার জন্য আপনি সবকিছুই করার চেষ্টা করবেন।
তাদের পাস দেওয়ার সুযোগ দেবেন না। প্রতিটি পয়েন্টের জন্য বাংলাদেশ এই কাজই করছে। তারা যাই করে, দল হিসেবেই করে’—গত বছর বাংলাদেশ দল সম্পর্কে কথাগুলো বলেছিলেন ভারত জাতীয় দলের ক্রোয়েশিয়ার কোচ ইগর স্তিমাচ।
ইংলিশ জেমি ডের জায়গায় এসে সে রক্ষণ সামলানোর দিকেই জোর দিয়েছেন স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। দল হয়ে রক্ষণ সামলানোটাই বাংলাদেশ দলের মূল শক্তি। ফুটবলের তিন প্রধান চরিত্রের দুটি ‘ডিফেন্ডিং’ ও ‘ট্রানজিশন’।
ট্রানজিশনের মধ্যে আরেকটি ভাগ ‘ডিফেন্ডিং ট্রানজিশন’। অর্থাৎ বল প্রতিপক্ষের পায়ে থাকলে ও হারালে নিজেদের গোলমুখে তালা মারার জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়া।
আক্রমণভাগ থেকে শুরু করে রক্ষণভাগ পর্যন্ত শৃঙ্খলিত হয়ে নিজেদের একসুতায় গাঁথা, ডি-বক্সের সামনে বিপজ্জনক মাঝ করিডরে প্রতিপক্ষকে কোনো জায়গা না দেওয়া এবং বিপজ্জনক পাস বন্ধ করা। ম্যাচের শেষ সময় পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে এভাবেই প্রতিপক্ষকে আটকে রাখতে চায় কাবরেরার দল।
সর্বশেষ ইন্দোনেশিয়া ও বাহরাইনের বিপক্ষে এ কৌশলে উন্নতি দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল। জেমি ডের আমলের ডিফেন্ডিংয়ের সঙ্গে বর্তমান দলটার ডিফেন্ডিংয়ের পার্থক্যটা হলো ফুটবলের ভাষায় ‘ডেপথ ডিফেন্ডিং’ ও ‘লো ব্লক’।
রক্ষণ সামলানোর জন্য জেমি তাঁর দলকে নিজেদের ডি বক্সের মধ্যে নামিয়ে রাখতেন আর কাবরেরা রাখছেন ডি বক্সের ওপরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বক্সের ৬ থেকে ১২ গজ সামনে। তাই ডিফেন্ডিং খেললেও চোখের জন্য খুব একটা পীড়াদায়ক হচ্ছে না।
এতে প্রতিপক্ষ ওপরে উঠে এলে তাঁদের পেছনে ফাঁকা জায়গা তৈরি হবেই। প্রতি আক্রমণে সেই সুযোগটা কাজে লাগানোর ছক কষছেন কাববেরার দল।
২. লম্বা থ্রো-ইন
প্রতিপক্ষ তুর্কমেনিস্তানের খেলোয়াড়েরা শারীরিকভাবে শক্তিশালী। তবু লম্বা থ্রো-ইন থেকে গোল পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। কারণ, তুর্কমেনিস্তানের বিশৃঙ্খল রক্ষণভাগ। সেট পিসে মধ্য এশিয়ার দেশটির ডিফেন্ডারদের ম্যান মার্কিংয়ে দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো।
গত বুধবার বাহরাইনের বিপক্ষে ম্যাচ খেলে হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ পরই বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ আবার ছুটে গিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে। গ্যালারিতে বসেই দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে মালয়েশিয়ার কাছে ৩-১ গোলে হারতে দেখেছে তুর্কমেনিস্তানকে।
সে ম্যাচে বাংলাদেশের কোচিং স্টাফদের চোখে ধরা পড়েছে তুর্কমেনিস্তানের রক্ষণভাগের বড় বড় ফাঁকফোকর। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের হাইলাইটস দেখলেও বোঝা যাচ্ছে তুর্কমেনিস্তানের রক্ষণভাগের মধ্যে প্রচুর সমন্বয়ের অভাব।
‘ওপেন প্লে’ থেকে সে সুযোগটা নেওয়ার ক্ষমতা তেমন নেই, সেটা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। তাই পাখির চোখ করেছে সেট প্লের লম্বা থ্রো-ইন থেকে। যেহেতু লম্বা থ্রো-ইন থেকে অতীতে বেশ কয়েকবার গোল পেয়েছে বাংলাদেশ।
নিয়মিত একাদশের খেলোয়াড়দের মধ্যে ডিফেন্ডার বিশ্বনাথ ঘোষ লম্বা থ্রো করেন। এ ছাড়া লম্বা থ্রো–ইনের জন্য আলাদাভাবে বাড়তি সুনাম কুড়ানো রায়হান হাসান ও রহমত মিয়া তো আছেনই।
৩. আস্থার নাম গোলকিপার আনিসুর রহমান
ফুটবলে একটি কথা আছে—রক্ষণভাগ, মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা যদি বিশ্বাস করতে পারেন, তাঁদের পেছনে গোলপোস্টের নিচে বড় দেয়াল আছে; এতেই নাকি দলের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
সে আস্থাটি অর্জন করে নিয়েছেন বাংলাদেশের গোলকিপার আনিসুর রহমান। সাদা চোখে সাহস ও আত্মবিশ্বাসই আনিসুরের সবচেয়ে বড় শক্তি। এ ছাড়া ফুটবলের ভাষায় ‘কম্পোজার’ও তাঁকে শক্তিশালী করেছে।
অর্থাৎ যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রেখে মোকাবিলা করা। যে কারণে ওয়ান-ওয়ান পরিস্থিতিতেও আনিসুরকে সহজে ফাঁকি দিতে পারেন না প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়েরা। এ ছাড়া প্রথম থেকে শেষ মিনিট পর্যন্ত বলের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারেন।
আনিসুরের কল্যাণেই ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে গোলশূন্য ড্র করে বাংলাদেশ। গত বুধবার এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের উদ্বোধনী ম্যাচে শক্তিশালী বাহরাইনের বিপক্ষে বাংলাদেশ দুটির বেশি গোল খায়নি আনিসুরের বীরত্বেই। আজও বাংলাদেশের বাকি খেলোয়াড়দের কাছে সবচেয়ে বড় আস্থার নাম আনিসুর।
৪. মালয়েশিয়ার কাছে তুর্কমেনিস্তানের ৩ গোল খাওয়া
র্যাঙ্কিংয়ে তুর্কমেনিস্তান ১৩৪ ও মালয়েশিয়া ১৫৪। অথচ গত বুধবার ২০ ধাপ এগিয়ে থাকা তুর্কমেনিস্তানকেই ৩-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে স্বাগতিক মালয়েশিয়া। সেদিন হার ছাড়াও খুব সাধারণ মানের ফুটবল খেলেছে তুর্কমেনিস্তান।
এতেই আশার পালে হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশের। প্রথমে সাহস দেখিয়ে ড্রর কথা বলছিলেন খেলোয়াড়েরা। এখন বলছেন জয়ের কথা। কুয়ালালামপুর থেকে এক খেলোয়াড় বলছিলেন, ‘তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গেই যদি পয়েন্ট না পাই, তাহলে আর কার সঙ্গে পাব।’
আজ বাংলাদেশের বিপক্ষে তুর্কমেনিস্তান পাচ্ছে না ডিফেন্ডার আবদি বাসিমোকে। আগের ম্যাচের শেষের দিকে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছেন ২৬ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডার।
৫. তুর্কমেনিস্তানের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ঘাটতি
তুর্কমেনিস্তানের বড় ঘাটতি সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খুব কম খেলা। সর্বশেষ মালয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলা ম্যাচটি দিয়ে গত এক বছরে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেছে তুর্কমেনিস্তান।
অথচ গত জুন থেকে এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ ম্যাচ খেলেছে ১৯টি। আন্তর্জাতিক ম্যাচে যে বাড়তি চাপ নিতে হয়, সে ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকবেন তুর্কমেনিস্তানের খেলোয়াড়েরা। যা গত বুধবার মালয়েশিয়ার বিপক্ষেই ফুটে উঠেছে।